অভিমন্যুদার (অভিমন্যু মাহাত) পোস্ট থেকে জানলাম একটি ‘অভিনব বাংলা অভিধান’-এ সাঁওতাল জাতির পরিচয়ে বলা হয়েছে — ‘সাঁওতাল পরগনার আদিম অধিবাসী; অসভ্যজাতিবিশেষ।’ সবচেয়ে মজার কথা, এই অভিধানটির সম্পাদকমণ্ডলীতে আছেন ভাষাবিদ, ভাষাতত্ত্ববিদ, শিক্ষাবিদ, অধ্যাপক, অধ্যক্ষ ইত্যাদি প্রভৃতি পদাধিকারীরা! সত্যিই কী বিচিত্র ‘সভ্যগণ’ ও তাঁদের ‘সভ্যতা’! এবং ‘শব্দসঞ্চয়িতা’ নামক আরও একটা অভিধানে অনুরূপ পরিচয় দেওয়া আছে, দেখলাম ওই পোস্টে। যে বইটির ভূমিকা লিখেছেন আবার অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। হঠাৎ করেই কিছুদিন আগে একটা জিনিস খুঁজতে গিয়ে নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’-এও এরকমই একটা শব্দ-ব্যবহারে চোখ আটকে গিয়েছিল। দাগিয়ে রেখেছিলাম। সুতরাং এই হেজিমনি আজকের নয়। এ এক নিরন্তর প্রয়াস। কীটের মতো বাসা বেঁধে আছে।
অর্ধাহার স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো হলেও অর্ধ-শিক্ষা অর্ধ-মনস্কতা অর্ধ-জাগরণ আর কতদূরই বা নিয়ে যেতে পারে?! আসুন এই ‘অসভ্যজাতিবিশেষ’-এর সঙ্গে একটু পরিচিত হওয়া যাক। আসলে মুন্ডা, সাঁওতাল, খাসিয়া, নিকোবর, আনাম, মালয় প্রভৃতি অধিবাসীরা যেসব ভাষায় কথা বলেন সেই ভাষাগুলো একই পরিবারভুক্ত। নাম — অস্ট্রি-এশীয় বা অস্ট্রিক। এই অস্ট্রিক ভাষা ও সংস্কৃতির অবদান বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি ও যাপনে নিশ্বাস-প্রশ্বাসের মতো জড়িয়ে আছে। আজ প্রায় আলাদা করাই যায় না। ভাবুন তো লাঙ্গল-গজ-মাতঙ্গ-গন্ডার-কপোত-বাণ-ধনুক-পিনাক-কার্পাস ও এরকম আরও বহু-অসংখ্য শব্দকে কি আজ আর আলাদা করে আমরা কেউ ভাবতে যাই যে এই শব্দগুলো অস্ট্রিক ভাষার অবদান? তবে প্রয়োজন পড়লে ভাবতে হয় বইকি! এই যেমন এখন হচ্ছে। অবশ্য শুধু বাংলা কেন, যে প্রাকৃত-সংস্কৃতের অপভ্রংশ থেকে বাংলাসহ বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষাগুলোর উৎপত্তি, সেই প্রাকৃত-সংস্কৃতের সঙ্গেও অস্ট্রিকভাষার ভালোরকম যোগ আছে। প্রাকৃত-সংস্কৃত ভাষায় সেই ঋগ্বেদের সময় থেকেই হয় অস্ট্রিকরূপে, না হয় সংস্কৃত-প্রাকৃতের ছদ্মবেশে অসংখ্য (অস্ট্রিক) শব্দ প্রচলিত আছে। শুধু শব্দগ্রহণ নয়, ব্যাকরণ ও পদরচনারীতিতেও অস্ট্রিক ভাষার ছাপ সেখানে স্পষ্ট।
শুধু ভাষা নয়, ভারতবর্ষ ও বিশেষত বাঙালির জীবনপ্রবাহে এই অস্ট্রিকভাষাভাষীদের প্রভাব যে কতদূর একাত্মীভূত হয়ে আছে তা আজ আর আলাদা করে খেয়াল করবার অবকাশটুকুও রাখেনি। প্রায় ঊনবিংশ শতাব্দী অব্দি যে ভারতবর্ষ ছিল মূলত কৃষিপ্রধান দেশ, সেই কৃষির প্রচলন অস্ট্রিকভাষাভাষীদের হাতেই। ভাবুন তো আপনি যখন ভাত খান, তখন যদি আপনি মনে করতে থাকেন একদা ‘অসভ্যজাতিবিশেষের’ হাতে প্রচলিত এই ধান চাষ এদেশে, সেই ভাত আমি খেতে যাচ্ছি; কিংবা কলা-বেগুন-লাউ-লেবু-পান-নারিকেল-কামরাঙ্গা-হলুদ-সুপারি এরকম আরও কত কী খাওয়ার সময় যদি আপনার মনে উঁকি দিতে থাকে এইগুলো ‘অসভ্যজাতিবিশেষ’ চাষাবাদ করত এবং আমি তা খাচ্ছি। ভাবুন তো কী গোলটাই না বাধবে! নিজের বমি নিজেকেই গিলতে হবে তখন! কেননা সেই পরিসরটি আপনিই তৈরি করেছেন। জন্মান্তরবাদ, পিতৃতর্পণ, পিণ্ডদান, বিবাহ- শ্রাদ্ধাদি সংক্রান্ত অনেক অনুষ্ঠানই আদিম অধিবাসীদের থেকে গৃহীত। এককালে বাঙালির জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল যে নবান্ন, বিভিন্ন ব্রতানুষ্ঠান, মনসাপূজা, ষষ্ঠীপূজা, এখনও ফি বছর শিবলিঙ্গে যে জল-দুধ ঢালা হয়, তা অস্ট্রিকভাষাভাষীদের ধর্মকর্মানুষ্ঠান থেকেই এসেছে।
অস্ট্রিকভাষাভাষীদের হাতে হরপ্পা-মহেঞ্জোদড়োর মতো কোনও নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা গড়ে ওঠেনি ঠিকই। কেননা তাঁদের জীবনযাত্রা ও সভ্যতা ছিল গ্রামকেন্দ্রিক। (অবশ্য কোনও কোনও জাতি অরণ্যচারীও ছিলেন।) কোনও কোনও গবেষক এমনটা মনে করেন যে, পঞ্চায়েত প্রথা ভারতে প্রথম এই অস্ট্রিকভাষাভাষীদের দ্বারাই প্রবর্তিত।
আর্য যেমন ভাষাগোষ্ঠী (জাতি নয়), তেমনি অস্ট্রিকও ভাষাগোষ্ঠী। এখানে ভালো-খারাপ, সভ্য-অসভ্য ইত্যাদি বাইনারির প্রশ্নই অবান্তর। কেবল ক্ষমতা, ক্ষমতার রাজনীতি ও অর্ধমনস্কতা এইধরনের উন্নাসিকতার জন্ম দিতে পারে। যে ক্ষমতার দম্ভ থেকে একই ভাষা পরিবারের হওয়া সত্ত্বেও নর্ডিক আর্যরা অ্যালপো-দীনারীয় জাতির লোকদের বলত ‘ব্রাত্য আর্য’। আর ‘সভ্য-অসভ্য’র প্রাকারটি যে কত ঠুনকো তা তো স্বয়ং বিদ্যাসাগর মশাই খুব সহজ করে একজন রেড-ইন্ডিয়ান ও ইংরেজের গল্পের ভিতর সেই কবে বলে গেছেন। এককালে গল্পটি বাংলা পাঠ্যসূচিতেও ছিল। বাঙালি অবশ্য পড়লেও তা নিশ্চয় মনে রাখেনি। যারা বিদ্যাসাগরকে মনে রাখে না, তাঁর একটি গল্পও গোলেমালে ভুলে মেরে দেওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি ভাবছি অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা কিংবা নীহাররঞ্জন রায়ের কথা। বাংলা ভাষা-সাহিত্যের ইতিহাস বা বাঙালির ইতিহাস বিচারের মতো গুরুভার যাঁদের কাঁধে; তাঁরা কীভাবে এমন সাধারণ প্রমাদ ঘটালেন?! নাকি বিশ্বজোড়া যে ফাঁদ, সেই ফাঁদটিকে ইন্ধন জুগিয়ে গেলেন এঁরাও?
ভাবা যায় একটি ‘সাঁওতাল’ ছেলে/ মেয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পড়তে গিয়ে ‘অসভ্যজাতিবিশেষ’ নামক একটি পরিচিতির সম্মুখীন হচ্ছে! সে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে ঠিক কীভাবে নেবে? বিশেষত সেই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি যখন তার ভাষাগোষ্ঠী ও সংস্কৃতির কাছে গভীরভাবে ঋণী! ব্যাপারটা দাঁড়াল এইরকম — তোমার ব্যবহৃত ও আবিষ্কৃত অনেক জিনিস ধারলাম, কোনওরূপ কৃতজ্ঞতার প্রশ্ন তো উঠলই না, বরং তোমাকে একটি ‘অসভ্যজাতিবিশেষ’-এ পর্যায়ভুক্ত করলাম। কারণ, ক্ষমতা আমাতেই পদানত। তাই উন্নাসিকতায় তোমাকে সামান্য জানার ইচ্ছেটুকুও হল না। আর এই অসভ্যর বিপরীতে, খারাপের বিপ্রতীপে সবসময় আমি একটি সুপিরিয়র, যে তোমাকে কেবলই মূল্যায়ন করি, কদাচ নিজেকে নহে।
অবশ্য প্রয়োজনে এই ‘অসভ্যজাতি, তথাকথিত অচ্ছুত, ম্লেচ্ছদের’ খানিক তোষামোদে, ব্যবহার করে নেওয়ার রাজনীতি আজকের নয়। তবু বিভাজনটি তাঁরা কাজেকর্মে তোলেন না। কেননা তুমি অধম না থাকিলে আমি উত্তম হইব কী করিয়া! আমার অস্তিত্বই নির্ভর করে আছে তুমি অধম-টি হইবার নিমিত্ত। এমনকী গান্ধিজির ‘হরিজন’ আখ্যাও সেই বিভাজনকে মোলায়েম করে বাঁধে। ঘুরিয়ে আসলে ‘মানুষে’র সম্মানটুকু দিতে অস্বীকার করেছিলেন, সম্মান দেওয়ার ছলে। ‘অনেক কথা যাও যে বলে, কোনও কথা না-বলি’র ছলে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতো কেউ কেউ সেই রাজনীতিকে অনুধাবন করেছিলেন। কলম ধরেছিলেন তার বিরুদ্ধে। বঙ্গভঙ্গের সময় রবীন্দ্রনাথ বারবার সেই সমস্যার দিকে দৃষ্টি ফেরাতে চেয়েছিলেন। আশার কথা এটাই।
Join the Discussion