A+ A-

শ্রীচ্যাটার্জির নিবৃত্তিবাসনা

প্রিয় পাঠক ও গুটিকয় পাঠিকা, গল্প লিখবার পূর্বেই এই ভয় আমাতে চাগিয়ে বসল যে, গল্পটিকে আপনারা হাসির গল্প বলে ভ্রম করবেন। সেই ভ্রম না করবার যথেষ্ট কারণ নেই, তা অস্বীকার করি না। বিশেষত মানুষের জীবনে উত্থান ও পতন সদাসর্বদাই অপরের হাসির কারণ হয়েছে। লেখক হিসেবে আমারও তেমন কোনও তেজঃরেত নেই যে, গল্পের মোড় প্রতিভার মোচড়ে ঘুরিয়ে দেব। যদি সত্যই পারতাম, তবে উল্লেখ থাক, এই গল্পটি নিতান্ত একটি সময়খণ্ডের, প্রোপাগান্ডা-তাড়িত এবং জীবনীমূলক। ইদানীং সাহিত্যসমাজে এক নতুন ধারা সামিল হইয়েছে, প্রকৃত ইতিহাসের সচেতন বিকৃতি করে গল্পের পাক নিগড়ে নেওয়া। বর্তমান গল্পকারও এই ধারায় প্রবাহিত হওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। অতঃপর এই গল্প, যেখানে তিনি ভেবেছিলেন, বৃহৎ ইতিহাসের খাঁজে পড়ে থাকা বটবৃক্ষের চারাটির কথা বিধৃত করবেন, কিন্তু তা বুঝি আর হল না!
গল্পটির সময়কাল ২০০৯ সাল, যখন সিঙ্গুরে গাড়িকারখানার পঞ্চব্যঞ্জনময় পাতে একগ্লাস জল ঢেলে দিয়ে রতন কুমার টাটা বাংলার আলপথ ছেড়ে বিদেয় নিচ্ছেন, সে সময় তথাগত চ্যাটার্জি নিজের কারখানা বানাবার সিদ্ধান্ত নেন। বাংলার শিল্পে অমানিশার আঁধার ছেয়ে এসেছে বলে নিউজপেপারগুলি সরব, কিন্তু তথাগত চ্যাটার্জি সেসবে ভ্রূক্ষেপ করলেন না। রতন টাটার মতো দূরদর্শিতা তাঁর ছিল না কোনওকালেই। শ্রীচ্যাটার্জি ব্যবসায়ীও নন, পুরোহিতবাড়ির ছেলে, লাভক্ষতির ঊর্ধ্বে উঠে তিনি মুহূর্তটিকে আন্দাজ করলেন। মুহূর্তের জীবনে জীবনের মুহূর্তগুলি তাঁর বালান্স শিটে ফুটে উঠল। যেমন অধিকাংশ বড় সিদ্ধান্ত তিনি একখানি ছোট ফ্রেমের ঠাকুর-সারদামা-বিবেকানন্দের ছবি দেখে করতেন, তেমনটাই তিনি ঈশ্বরকোটির ছবির দিকে চেয়ে নিশ্চিন্ত হলেন —সেই শুভক্ষণ আগত। রাজনৈতিক বোধবুদ্ধি, ব্যবসায়িক বিচক্ষণতা কিম্বা সামাজিক গুণাগুণে তিনি উৎকৃষ্ট — এমন দাবি কেউই করবেন না। তেমনই কেউ বলতে পারবে না যে, তিনি জীবনে ব্যর্থ। উলটে বলা যায় তিনি সফল, তাঁর প্রজন্মের সফলতরদের থেকে তিনি বেশি সফল।

আপাতত ব্যবসায়ের খুটিনাটিতে যাওয়ার আগে শ্রীচ্যাটার্জির পূর্বজীবন সম্পর্কে গুটিকয় কথা বলে ফেলা যাক। চতুর্থ বামফ্রন্ট যে বছর গঠিত হল, শ্রীচ্যাটার্জি সে বছর জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় সাতশ’র ঘরে র‍্যাঙ্ক করে যাদবপুরের সিভিল এঞ্জিনিয়ারিং মিস করে অনিচ্ছেসত্ত্বেও শিবপুর বি ই কলেজে মেটালার্জি নিয়ে ভর্তি হলেন। তিনি ছিলেন বাপমায়ের একমাত্র সন্তান, বাপ অকাল-অবসর নিয়ে শয্যাশায়ী, সুগার-ব্লাড প্রেশার ইত্যাদির রুগি। শিয়ালদহ কোর্টে ব্যবহারজীবী ছিলেন, পারিবারিক বৃত্তি যজমানির। কোঅপারেটিভ থেকে সাড়ে আট পার্সেন্ট সুদে ঋণ নিয়ে ছেলেকে কলেজে পড়ানোর ব্যবস্থা করলেন। শ্রীচ্যাটার্জি বাপের ঘাড়ের বোঝা লাঘবে কিছু কম তৎপর ছিলেন না। বন্ধুদের ঘাড় ভাঙতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত, মাস্টারমশায়দের করুণা আদায়ে ছিলেন দড়, লেখাপড়াতেও গড়পড়তার কিছু উপরের দিকেই ছিলেন। কেবলমাত্র তাঁর যাবতীয় কারিকুরি ফাঁস হয়ে যেত স্কলারশিপ কমিটির সামনে পড়লেই। হ্যাঁ, অবশ্যই তিনি নানাপ্রকার স্কলারশিপ পাওয়ার জন্য আবেদন করতেন, কিন্তু যাবতীয় বৃত্তিপ্রদানকারীরাই শ্রীচ্যাটার্জির বিপুল বপু দেখে তাঁকে ‘দুঃস্থ অথচ মেধাবী’ বলে মানতে চাইতেন না। এর যে কোনও একটি মানতে তাঁদের আপত্তি নাও থাকতে পারত, কিন্তু শ্রীচ্যাটার্জি কী করে তাঁদের সন্তুষ্ট করবেন যে, সত্যাসত্যই তাঁর পিতৃদেব কাবুলিওয়ালার সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক পাতানোর উপক্রম করে স্বীয় পুত্রের এই গতরখানি বানিয়েছেন। এই গতরটিকে ‘অনেক তপস্যার ফল’ বলে বর্ণনা করলে আমার এই ভয় হয় গল্পখানির নিয়তিও বুঝি রম্যরচনায় পতিত হয়। জনৈক পাঠিকা অভিযোগ করেছেন, আমি নাকি বড়ই চরিত্রদের পূর্বজীবন নিয়ে মেতে উঠি। তাঁর অভিযোগটির সত্যতা স্বীকার করে নিয়ে এই গল্পে আমি যতদূর সম্ভব নিজেকে তেমনটা করা থেকে নিবৃত্ত করবো। শুধু আপনারা বুঝুন, স্ট্রাগল তারও ছিল। খুচরো প্রেম, মাতলামো, দোকানে ধার তাঁর থাকলেও থাকতে পারে, তদুপরি থলথলে একটি ভুঁড়িও ছিল। চাকরির ইন্টারভ্যুতে তাঁর হবু বস তাঁকে দিয়ে কড়ার করিয়ে নিয়েছিলেন, চাকুরিটি হস্তগত হলে তিনি পরিশ্রমে ফাঁক রাখবেন না। শ্রীচ্যাটার্জি তাঁর প্রতিশ্রুতি থেকে বিচ্যুত হননি।

এইবার মফস্বলী, মধ্যবিত্ত, বাঙালি ছেলের মাথায় ব্যবসার ভূত কী করে চাপল, তার খানাতল্লাশি করা যায়। কলেজের পর বন্ধুজন যখন দেশেবিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে, শ্রীচ্যাটার্জি দস্তাখনির কারখানায় চাকরি নিয়ে রাজস্থানে থিতু হলেন। তাঁর ব্যাচে চুয়াল্লিশজন সাকুল্যে, সারা ভারত থেকে, দস্তা কারখানাটিতে চাকরি পেয়েছিল। বৎসারান্তে দশজন এবং পাঁচবছরে দেখা গেল মেরেকেটে একজন, শ্রীচ্যাটার্জি, মোটে পড়ে আছেন। গরমঠান্ডা, ডালবাটিচুরমা, শ্রমিক অসন্তোষ, টেম্পরারি লকআউট, রক্তে সুগারের ধাত তাঁর সহ্য হয়ে গেছে। তাঁকে মায়ার পাশে বেঁধে রাখতে কোম্পানি উপুর্যুপরি বোনাস, শেয়ার দিতেও কসুর করছে না। শ্রীচ্যাটার্জি দাঁত কামড়ে পড়ে রইলেন, পাঁচবছরের অভিজ্ঞতা দশ বছরে পৌঁছল, পনেরো ছুঁল। পাঠক স্মরণ করুন, সদ্য বিলগ্নিকরণের দিনগুলি সম্বল করে দেশ ও জতি তখন ঝকমকাচ্ছে। দস্তা কারখানার সৌজন্যে শ্রীচ্যাটার্জি চিনদেশ এবং ইউক্রেন ভ্রমণ করে এলেন। অধাতু-আকরিক নিষ্কাশনের আধুনিকতম জ্ঞান তখন তাঁর করায়ত্ত। এই প্রসঙ্গে বলা যাক, চিনপ্রদেশে ভ্রমণকালীন একটি চিনামেয়ের সঙ্গে তাঁর ভাবভালোবাসাও হয়। মেয়েটির নাম লি ঝুই। দেশে ফিরে শ্রীচ্যাটার্জি প্রেমনিবেদন না করার জন্য প্রবল হাত কামড়ান এবং প্রবৃত্তিবশত অফিসের ইমেল থেকে একখানি প্রেমপত্র লেখেন। ইনিয়ে বিনিয়ে বলা নানা কথার মাঝখানে তিনি লিখেছিলেন — ‘আজ ফিরে এসে, দেশে আমগাছের শীতল ছায়ার বসে সতত তোমাকে মনে পড়ে।’ কিছুটা মধুসূদনের ‘কপোতাক্ষ’ কবিতাটির প্রভাব ছিল বইকি। লি ঝুই ফিরতি ইমেলে লেখেন — ‘ওয়াট ইজ এ ম্যাঙ্গোট্রি?’ ব্যাপারটির সেখানেই ইতি ঘটে! এইটুকু না বললেও হয়তো চলত, কিন্তু শ্রীচ্যাটার্জি কেবলমাত্র হবু বিজনেসম্যান নন। মানবসুলভ দোষগুণ প্রবৃত্তি তাঁরও আছে, অথবা ছিল। পনেরো বছর চাকরি করার পর দেশবিদেশের হরেক টেকনোলজি যখন তাঁর হাতের মুঠোয়, একদিন অফিসের কনট্রাকটরদের সঙ্গে পার্টিতে গর্বভরে সেকথা বলাতে মাড়োয়ারির ব্যাটারা প্রস্তাব দিল —সাহেব, এতই যখন আপনি জানেন, পরের ঘরে নোকরি কেন করছেন!

সুধী পাঠক ও গুটিকয় পাঠিকা, আপনারা কি কখনও লক্ষ করে দেখেছেন, সব মহান মানুষের জীবনেই এমন একটি মুহূর্ত আসে, যখন সাধারণ মানুষও মহত্ত্ব অর্জন করে ফেলে, যেমত প্রথম অগ্নি প্রজ্বলনের ক্ষণ। শ্রীচ্যাটার্জির জীবনেও এটি সেই মুহূর্ত। এরপরে তিনি আর পিছন ফিরে দেখেননি। পাঠক ও গুটিকয় পাঠিকা, আপনারা জীবনভর আক্ষেপ করুন, আপনাদের জীবনে এমন মাহেন্দ্রক্ষণ এল না! যাবতীয় জ্ঞান মগজের মধ্যে ধরেও জীবনে তার প্রায়োগিক দিকটির কথা শ্রীচ্যাটার্জি অনুধাবন করতে পারেননি। মাড়োয়ারিনন্দন ঠিকাদারটি শিভাস রিগ্যালের ধুনকি নিয়ে শ্রীচ্যাটার্জির মাথায় বীজমন্ত্র বসিয়ে দিল, সাফল্যের সিঁড়ি থেকে এলিভেটারে চড়বার রাস্তা খুলে দিল।

কন্ট্রাকটারটি জমি, ব্যাংকের লোন প্রভৃতির প্রলোভনও দেখিয়েছিল, শ্রীচ্যাটার্জি সেসব গায়ে মাখেননি। কোম্পানি, নিজের কোম্পানি খুলবেন, অপরের গলগ্রহ হওয়ার কী প্রয়োজন। তিনি ঠিক করলেন চাকরিতে ইস্তাফা দেবেন, লোন নেবেন আর বাংলার মাটিতে নিজের কারখানা খুলবেন। কিন্তু জগতটা এমন যে, উচিৎ ভাবলেও ভাবনা অনুযায়ী কর্ম তৎক্ষণাৎ করা হয়ে ওঠে না। শ্রীচ্যাটার্জির মা-বাপ জীবিত, প্রায় অথর্ব, মাঝে মধ্যেই শ্রীচ্যাটার্জিকে বিয়ে করবার জন্য তাড়া দেওয়া ব্যতীত তাঁদের আর কিছুতে উৎসাহ নাই। শ্রীচ্যাটার্জি আজ না হয় কাল, কাল না হয় পরশু বলে ব্যাপারটা ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। এইবার পাকাপাকি জানা্লেন, বিয়ে করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ জীবনে তিনি উন্নতি করতে চান। মা নীরব হলেন, বাপ কপাল ঠুকলেন — আমাদের মধ্যবিত্ত ঘরে জন্মে গাড়ি কিনেছ, মায়ের জন্য এসি বসিয়েছ, দোতলা উঠেছে। আর কত উন্নতি প্রত্যাশা করো! শ্রচ্যাটার্জি ফিক্সড ডিপোজিটের পরিমাণ আরও কয়েক হাজা্র বাড়িয়ে তাঁদের আশ্বস্ত করলেন। উপরওয়ালা বলল, মার্চে প্ল্যান্টে কমিশনিং হবে। সর্বক্ষণ চালু থাকা প্ল্যান্ট একমাসের জন্য প্রতি পাঁচ বছরে সামগ্রিকভাবে বন্ধ হবে। তারপর দু’মাস সময় লাগবে আবার সম্পূর্ণভাবে প্ল্যান্ট চালু হতে। ম্যানেজমেন্টের সাধ্য কী এমন কর্মযজ্ঞ সামলায়! খাতিরবশত শ্রীচ্যাটার্জি কয়েকমাস রেজিগনেশান স্থগিত রাখলেন।

এই সময়ে তিনি ব্রতী হলেন কারখানার কাগজপত্রের ব্যাপারটা এগিয়ে রাখতে। কারখানা হবে মেটাল এক্সট্রাকশানের। কলকাতার মার্কেটে প্রতিবছর পাঁচহাজার মেট্রিক টন হার্ডঅয়ার-বর্জ্য উৎপন্ন হয়। অর্থাৎ কিনা ভাঙা কম্পিউটার, প্রিন্টার, সার্কিট ইত্যাদি। কলকাতা হার্ডঅয়ার-বর্জ্যের নিরিখে ভারতে তিন নম্বর শহর, সুতরাং কাঁচামালের আক্রা হবে না। এইসব জাঙ্ক রদ্দিদরে বিক্রি হয়, ল্যান্ডফিল করা হয়। লোহা বা অন্যান্য ধাতুর জাঙ্কের বাজার আছে, সেখানে দাদাগিরি, তোলাবাজি চলে। কিন্তু হার্ডঅয়ার জাঙ্কের বাজার নিষন্টক। এমন জাঙ্কে অতি অল্প পরিমানে সোনা, রূপা, তামার মতো মূল্যবান ধাতু মিশে থাকে। খালি চোখে তা সনাক্ত করা মুশকিল এবং নিষ্কাষণ করে, সেগুলি সংযুক্তি-বিযুক্তির মাধ্যমে সত্তর থেকে আশি শতাংশ বিশুদ্ধ ধাতুতে রূপান্তরিত করা যাবে। আইডিয়া যখন মাথায়, তাঁর চাই জমি এবং বিনিয়োগ। একবার ব্যবসা দাঁড়িয়ে গেলে ক্রেতার অভাব হবে না, সকল ব্যবসায়ীর মতোই শ্রীচ্যাটার্জিও তাই ভাবলেন।

প্ল্যান্টে কমিশনিং চলাকালীন প্রত্যহ সন্ধে অথবা গভীর রাতে শ্রীচ্যাটার্জি নিজ-ব্যবসা শুরু করার বিষয়ে পড়াশুনা শুরু করলেন। যুক্তরাষ্ট্রীয় নানা অগ্রপথিক যথা ওয়ারেন বাফেট, স্টিভ জোবস প্রমুখের জীবনী এবং ব্যবসা সংক্রান্ত বইপত্তর রাজধানী দিল্লি থেকে খরিদ করে আনলেন। একবার পড়া শুরু হতেই, দীর্ঘদিনের মনোযোগহীনতা, বারংবার ধূমপানের ইচ্ছে, দু’চোখ জোড়া ঘুম পেরিয়ে শ্রীচ্যাটার্জি দুটি জিনিস বুঝতে পারলেন — এক, টেকনোলজি ও প্রোডাক্ট ব্যবসার হিমশৈল মাত্র, প্ল্যানিং-কস্টিং-ফান্ডিং-শেয়ার-রিটার্ন প্রভৃতির আন্টার্টিকাসম মহাদেশ জলতলে লুক্কায়িত রয়েছে। এবং এর বিন্দুবিসর্গ তিনি জানেন না। এক্ষণে তাঁর মনে পড়ল সে মেড়ো কন্ট্রাকটরটির কথা, তার কথা শুনে রাজস্থানে প্ল্যান্ট বানালেই সাধ্যের মধ্যে সাধপূরণ হত। যাই হোক, দ্বিতীয়ত শ্রীচ্যাটার্জি বুঝলেন বইপত্তর পড়ে এসবের কোনও কেশই তিনি উৎপাটন করতে পারবেন না। ফলত, তাঁর নির্ভরযোগ্য বিশেষজ্ঞ চাই।

শ্রীশর্মা এবং শ্রীদাশ দুজনেই শ্রীচ্যাটার্জির আস্থাভাজন, কলেজজীবনের বন্ধু এবং বিশেষজ্ঞ। শ্রীশর্মা ঝাড়খণ্ডী, টাটা স্টিলের উচ্চপদাধিকারী, ব্যবসাটা বোঝেন। অপরদিকে শ্রীদাশ সম্প্রতি বিলেত থেকে অধ্যাপনার চাকরি ছেড়ে মহেশতলায় ফ্ল্যাট কিনে মেমবউকে নিয়ে থিতু হয়েছেন। দুর্জনে বলে বিলেতে থাকাকালীন হেজফান্ডে টাকা খাটিয়ে তিনি পর্যুদস্ত। যেটুকু হাঙরের হাঁ থেকে বেঁচে ফিরেছে তা দিয়ে মহেশতলাতেই দু’কামরা, বাচ্চার সাউথ পয়েন্ট, বউয়ের মারুতি হয়; বিলেতের স্বাচ্ছন্দ্যে থাকা সম্ভব হয় না। শ্রীচ্যাটার্জি টেলিফোন করে শ্রীদাশকে তাঁর পরিকল্পনা জানালেন, শ্রীদাশের আইনকানুনের জ্ঞান আছে, রাজনীতি বুঝতেন, জ্ঞানগম্যিও ভালোই ছিল। শ্রীদাশ উৎকণ্ঠিত হলেন, কুড়িয়ে বাড়িয়ে ব্যাংকে তাঁর ওই ক’টি টাকা পড়ে আছে, তিনি সভয়ে বললেন, ভাইরে, কৃষ্ণের মতো তো্মার সঙ্গে রইলাম, রথ টেনে দেব, তির-ধনুক ছুঁড়তে পারব না। শ্রীচ্যাটার্জির ওতেই চলবে।

আরেক দোস্ত, শ্রীশর্মার গোটা পরিবার ব্যবসায়ী, চাকুরির পাশাপাশি তিনিও বহাল তবিয়তে ব্যবসা করেন। জামশেদপুরে পুরানো রেফ্রিজারেটারের কলকব্জা খুলে ভোল পালটে ‘শর্মাজ’ ব্র্যান্ডে রিসেল করেন। তাঁকে প্রস্তাব দেওয়ামাত্র তিনি রাজি, খরচখরচার সব হিসেব তিনি মিলিয়ে দেবেন। কিন্তু গোল বাধল অন্যত্র। কলেজজীবনে শ্রীশর্মা এবং শ্রীদাশের পারস্পরিক সম্পর্ক মোটেই সুবিধার ছিল না। কী কারণে সম্পর্কতা কেঁচে গেছিল, প্রায় দু’দশক পরে দুজনার কেউই মনে করতে না পারলেও পরস্পরকে আজও তাঁরা ‘জোচ্চোর’ সম্বোধন করতে ভুললেন না। তখনকার মতো দুজনকেই শ্রীচ্যাটার্জি আশ্বাস দিলেন, অপরপক্ষের সঙ্গে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে তিনি নিজে সতর্ক থাকবেন; অপরজনকে না দেখিয়ে কোনও নথিতে সই করবেন না এবং তাঁরা দুজন মিলিয়ে শেয়ার সোওয়া ছেষট্টি পার্সেন্ট হলে তৃতীয়জনকে লেম-ডাক হয়ে বসে পড়তে হবে। ব্যাপারটিকে সাইলেন্ট পার্টনারও বলা যায়, কিন্তু অলস পক্ষীটির গলায় জোর থাকবে না একথা কে নিশ্চিত করে বলতে পারে! মনকষার সেখানেই ইতি হল।
শ্রীশর্মা সপ্তাহ ঘোরার আগেই বিস্তর এক্সেলশিটের চৌকো বাক্সের সমাধা করে, সকালসন্ধ্যা হাইপ্রেশারের বিটাব্লকার খেয়ে সিদ্ধান্তে এলেন, ছ’কোটি টাকা মূলধন দরকার। স্পিন আপ পিরিয়ড যাবে অনধিক দু’বছর, কোম্পানি ততদিন লাভের মুখ দেখবে না, তিন বছরের পর থেকে কোম্পানি লাভ করতে শুরু করবে। এইক্ষেত্রে সর্বাধিক দুরবস্থা এই হতে পারে যে, গোটা মূলধনটাই ঋনে নেওয়া হল, সেক্ষেত্রে লাভের বখরা হাতে পেতে আরও তিন বছর অপেক্ষা করতে হবে। শ্রীচ্যাটার্জি এমন গণনায় যারপরনাই খুশি হলেন। তাঁর সাত আঙুলে অপরাজিতা নীলা, হীরা, চুনি, পান্না, ক্যাটস্‌ আই, মুক্তা, রক্তমুখী নীলা। বাল্যকালে শুনেছিলেন, রাজযোগ আছে। কতকটা যেন সেদিকেই জীবন এগুচ্ছে, শ্রীশর্মা আরও জানালেন এই গণনায় ইনি এতটাই সন্তুষ্ট যে, পাইলট প্রোজেক্টের কোনও প্রয়োজন নাই, সিধা পুরোদমে কারখানা বানানোর কাজ শুরু করা যাক, গণনাটি শ্রীচ্যাটার্জি শ্রীদাশকে দেখালেন, তিনিও সন্তুষ্ট হলেন। শ্রীদাশ এতদিনে আন্তেপ্রেনিওরশিপের বাঘা বাঘা সব বই পড়ে ফেলেছেন।
শ্রীদাশ সহজ ভাষায় তাঁর বন্ধুকে বোঝালেন, ব্যবসায়িক উদ্যোগের অভিমুখ দুইটি — এক, জমি সংগ্রহ করা এবং দুই, মূলধন জোগাড় করা। জমি একবার জোগাড় হলে নানাবিধ ক্লিয়ারেন্স পেরোতে হবে। যার মধ্যে দীর্ঘতম বাম্বুটি হল এনভায়রনমেন্টাল ক্লিয়ারেন্স। অন্যদিকে টাকাপয়সার সংকট মিটলেই কারখানা গড়া শুরু করা যায়। এসময় আমরা আরও সব পারমিট, লাইসেন্স — যেমন বয়লার লাইসেন্স, ফায়ার লাইসেন্স, লেবার লাইসেন্স ইত্যাদি নিয়ে নেব। তারপরেই প্রোডাকশান শুরু। তুমি ভেবো না, আমি আছি। শ্রীচ্যাটার্জি বললেন, লোকমুখে শুনেছিলাম, দিল্লির কংগ্রেস সরকার নাকি সেজ-নীতি গ্রহণ করেছে, সে প্রকল্পের অধীনে সস্তায় জমি মিলবে। বস্তুত লোকমুখে নয়, শ্রীচ্যাটার্জি টিভিতে আমির খান অভিনীত ‘তারে জমিন পে’ দেখাকালীন সরকারি বিজ্ঞাপনে শুনেছিলেন। শ্রীদাশ তাঁকে আশ্বস্ত করে বললেন, ওয়েস্ট বেঙ্গলের ঝামেলায় আর সেজ খুঁজে লাভ নেই, বরং আমি এদিক ওদিক দেখছি, প্রাইভেট ল্যান্ড কিনব। ওটা তুমি আমার উপর ছাড়ো, তুমি বরং মূলধনের ব্যাপারটা দেখো।
মূলধন দেখা গেল তিনজনের পকেট থেকে ঝেড়েঝুড়েও কোটি ছাড়াচ্ছে না। এর মধ্যে শ্রীশর্মা একাই দু’কোটি টাকা ইনভেস্ট করবেন বলে সংকল্প করেছিলেন। কিন্তু মালিকানার প্রসঙ্গ তুলে তাঁকে নিরস্ত করা হয়।

শ্রীশর্মা শ্রাগ করেন এবং অন্তরালে বলেন, খুদকা অউকাদ নেহি, অওর দুসরেকা হাত থামনেকা জিগর নেহি। শ্রীচ্যাটার্জি তখন ব্যাঙ্কে ব্যাঙ্কে খোঁজখবর শুরু করেন, কিছু ব্যাঙ্কে বড়-লোন পাওয়া যায় বটে, ব্যবসায়িক কারণেই, কিন্তু তাও দু-তিন কোটির বেশি নয়। শ্রীচ্যাটার্জি সপ্তাহান্তে ছুটি নেন এবং ইকনমি ক্লাসের টিকিট খরিদ করে বোম্বে যান, সস্তার হোটেলে ওঠেন এবং ইনভেস্টার সামিটে যোগ দেন। সবিস্ময়ে তিনি সেখানে লক্ষ করেন, ইনভেস্টাররা বিন্দুমাত্র প্রোডাকশান মার্কেটে আগ্রহী নয়। আগডুম বাগডুম এবং অলীক অনলাইন সফটওয়ার-কম্পিউটার কোম্পানিতে তাদের নজর। হতাশ হয়ে শ্রীচ্যাটার্জি ফিরে আসেন। ইনভেস্টার পাওয়া গেলে তাঁর ঘাড়ে ব্যর্থতার দায় কিছু কম চাপত। ব্যাঙ্কের লোন মেটাতে না পারলে ঝক্কি প্রচুর, তবু তিনমাথার শলায় তাই ঠিক হল। সকলেই এক-তৃতীয়াংশ অর্থ ঋন নেবেন।

এ পর্যন্ত স্থির হওয়ার পর শ্রীচ্যাটার্জি নিজের চাকুরিস্থলে পাকাপাকিভাবে ইস্তাফাপত্রটি দাখিল করলেন এবং একমাসের নোটিসপর্ব অন্তে বাক্সপ্যাঁটরাসমেত অনন্যা এক্সপ্রেসে চেপে শিয়ালদহ স্টেশানে এসে নামলেন। দুটো দিন বাড়িতে মায়ের নির্দেশে কাজের মাসির আদর-যত্নে কাটিয়ে জোরকদমে কাজে নেমে পড়বার সিদ্ধান্ত নিলেন। শ্রীদাশ এসময় উলুবেড়িয়ার দিকে একটি বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়াচ্ছিলেন। তিনি একবেলার ছুটি নিলেন। জামশেদপুর থেকে ইস্পাত ধরে এলেন শ্রীশর্মা। চেক-ইন করলেন পার্ক হোটেলে। তিন বন্ধু মিলে শরাবের গ্লাস হাতে অলিপাবে গিয়ে বসলেন। ওয়েটারের কাছে পেপারটিস্যু চেয়ে নিয়ে নোট নেওয়া শুরু হল। শ্রীশর্মা তাঁর পামটপটি বের করতে উদ্যত হয়েছিলেন, কিন্তু টেবিলের উপর হুইস্কির দাগ।

কাজের কথা যত না হল, অকাজের কথা হলো তার চেয়ে ঢের বেশি, ফিশফিঙ্গার হল সবচেয়ে বেশি। শ্রীশর্মা গৃহে নিরামিষ আহার করে থাকেন, সুযোগ বুঝে তিনি বিফস্টেক অর্ডার করলেন। স্মৃতিচারণা হল, পরস্পরের কাজকর্ম আর ব্যাঙ্কব্যালেন্স বিষয়ে জানা গেল। তিন রাউন্ডের পর সকলে যখন নেশার ঘোরে ঢুলে পড়ার উপক্রম, শ্রীদাশ জানালেন, তিনি একটি উপযুক্ত জমির সন্ধান পেয়েছেন। জমিটি শিয়ালদা উত্তর শাখার ঠাকুরনগরে, তাঁর অতিঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর পৈত্রিক বাড়ি ও সংলগ্ন জমি। বন্ধুটি বহুকাল হল শহর কলকাতায় উঠে এসেছে, উর্বর জমি, ধনেপাতা চাষ হয়। বর্ডার লাগোয়া অঞ্চল হওয়ায় এই জমি আঁকড়ে থাকা মুশকিল। সকাল-বিকেল দালালদের ভনভানানিতে প্রাণ ওষ্ঠাগত। বন্ধুটি তাই উপযুক্ত ক্রেতা পেলে, দালাল নিষ্প্রয়োজন, জলের দরে ছেড়ে দেবে। সাত বিঘে জমি, দশ হাজার টাকা কাঠা। শ্রীচ্যাটার্জি লাফিয়ে উঠলেন, তাঁর বাড়ি থেকে ঠাকুরনগর গাড়িতে ঘণ্টাখানেকের পথ। এমন জমি হাতছাড়া করা খুবই ভুল হবে। অগ্রিম ধরিয়ে একটা শিলান্যাস করে ফেললে আর কোনও চিন্তা নেই। মদের গ্লাস হাতে নিয়ে লক্ষ্মীচিন্তা করবেন না বলে শ্রীশর্মা চুপ রইলেন। শ্রীচ্যাটার্জি বললেন, ম্যায় তুমহারে সাথ বাদমে বাত করুঙ্গা।

শ্রীদাশ বললেন, জমিকেনা রেজিষ্টি বাবদ লাখ কুড়ি টাকা তো লাগবেই, তার অন্তত আধেক অগ্রিম ধরাতে হবে। ব্যাঙ্কের লোন অ্যাপ্লিকেশান এখনও পড়েই আছে। টাকাটার জোগাড় কী উপায়ে হয়?
শ্রীচ্যাটার্জির নেশা চড়ছিল, তিনি নিজেকে সামলে বললেন, শিল্পোন্নয়ন নিগমে একটা আবেদন ঠুকলে হয় না? আমাদের কারখানায় লোকাল ছেলেপুলের চাকরি হবে, ডেভেলাপমেন্ট হবে। গওরমেন্ট কিছু সিডমানি দিয়ে ব্যবসাটা শুরুর হেল্প করতে পারে না?
শ্রীদাশ মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বললেন, সেসব খোঁজ নিয়েছি, গভমেন্ট ছোট শিল্পে ঋন দেয়। কিন্তু ছোট শিল্প বলতে গভমেন্ট মিনিমাম তিরিশ কোটির প্রোজেক্ট বোঝে!
শ্রীচ্যাটার্জি হতাশ হলেন — এমন জমি বুঝি হাতছাড়া হয়!
শ্রীদাশ প্রস্তাব দিলেন — কোম্পানিতে ইস্তফা দিয়ে তুমি তো ভালোই টাকাপয়সা পেয়েছ। সেখান থেকে কিছু দিলে জমিটা বুক করে রাখতাম। পরে যখন লোন সাংশান হবে তখন লোনের থেকে সরিয়ে তোমাকে দিয়ে দেব।
শ্রীচ্যাটার্জির প্রস্তাবটা নেহাত মন্দ লাগল না। টাকা তিনি অনেকই পেয়েছেন। পিএফ-এর পরিমাণই কম নয়। টাকা ক’টা তিনি দিয়ে দিলে বেচারা সংসারীদের এই মুহূর্তে আর সেভিংস ভাঙতে হয় না। তিনি সন্মত হলেন। যেখানে জমির রেজিস্ট্রেশান হবে কোম্পানির নামে, সেখানে আর ভয় কী! শ্রীশর্মা কেবল বিফস্টেকের প্রশংসা করলেন কয়েকবার। আলোচনার মোড় শ্রীচ্যাটার্জির এক প্রাক্তন প্রেমিকার দিকে চলে গেল। সকলে নেশার কবলে পড়ে গেলেন। প্রেমিকাটি আজও অবিবাহিত।
পরদিন খোঁয়ারি ভাঙার পর পার্ক হোটেলের ঘর থেকে শ্রীশর্মা শ্রীচ্যাটার্জিকে ফোন করলেন। শ্রীচ্যাটার্জি তখন কাজের মাসির বানানো লুচি আর খাসির মাংস দিয়ে প্রাতরাশ সারছেন। একগলা বিরক্তি নিয়ে তাঁকে শ্রীশর্মা বললেন, এ কোথায় জমি কিনতে যাচ্ছিস, চাষবাষের জমি, করিয়েনডার চাষ হয়, এনভায়রেনমেন্টাল ক্লিয়ারেন্স পাবি না।
শ্রীচ্যাটার্জি শ্রীদাশের পলিটিকাল কানেকশানের কথা জানতেন, তিনি আশ্বস্ত করলেন, এই মরসুমের চাষ হয়ে গেলেই ওই জমিতে ছাই ফেলে ব্যারেনল্যান্ড বানিয়ে দেওয়া হবে। শ্রীশর্মা কোম্পানির লোগোটা বানিয়ে ফেলেছিলেন, নাম ভেবেছেন ‘ই-জাঙ্ক ইন্ডাস্ট্রি’। শ্রীচ্যাটার্জিকে জানালেন, তিনি কলকাতায় থাকতে থাকতে শ্রীচ্যাটার্জি এসে যেন লোগোটার কপি নিয়ে যান। শ্রীচ্যাটার্জি ফোন রাখলেন, ছেলেকে আমোদ করে খেতে দেখে বুড়োবাপ খাটের একপাশে হাতল ধরে বসলেন। ইনিয়েবিনিয়ে বিয়ের কথা পাড়লেন, মা বাতের ব্যথা সামলে দরজার ওপাশে কানখাড়া করলেন। শ্রীচ্যাটার্জি নিবিষ্ট মনে মাংসের হাড় চুষছিলেন। উত্তর না পেয়ে বাপ মোক্ষম কথাটা আর পেটে রাখতে পারলেন না — তোর কি অন্যরকম কোনও সমস্যা আছে? শ্রীচ্যাটার্জি বিষম খেলেন। দরজা ঠেলে বাপকে শাপশাপান্ত করতে করতে মা ঘরে প্রবেশ করলেন।
শ্রীচ্যাটার্জি অনেকদিন পর ছুটির আমেজ অনুভব করছিলেন। প্ল্যান্টের ডিউটিতে ভাইস প্রেসিডেন্ট থেকে ফোরম্যান অবধি সবাইকে হাইঅ্যালার্ট থাকতে হয়। দিন নেই রাত নেই, অনেকে কম্বল টেনে বয়লারের পাশেই ঘুমিয়ে পড়ে। চাকরি ছাড়ার পরে এখন তিনি হাত-পা ছাড়া, সেলুনে গিয়ে পেপার পড়তে পড়তে চুল কাটাচ্ছেন, বিকেলে বেরিয়ে চপমুড়ি কিনছেন, টিভিতে সিরিয়াল দেখছেন। এমনকী সেদিন অলিপাবে কথাবার্তার মধ্যে উঠে আসা প্রেমিকাটির মুখ অবধি বেখেয়ালে মনে পড়ে গেল। এর মাঝে একদিন তিনবন্ধু মিলে টাটা সুমো ভাড়া করে জমিটা দেখে এলেন। শ্রীচ্যাটার্জি অ্যাডভান্সের চেক কেটে দিলেন। উকিলের উপস্থিতিতে প্রাথমিক কাগজপত্রে সইসাবুদ হল। শ্রীদাশ করিৎকর্মা লোক, তিনি ইতিমধ্যেই জামশেদপুরে হেডফিস দেখিয়ে কোম্পানির নামটা রেজিস্টার করে রেখেছেন, শ্রীচ্যাটার্জি অতীব প্রীত হলেন।
তাঁর কল্পনার চেয়েও দ্রুত কাজ এগুচ্ছে। এইবার নানা রকম ক্লিয়ারেন্স জোগাড় করার পালা। জমিটা বাস্তুজমি হিসেবে রেজিস্টারে ঢুকেছে, সেটাকে ইনড্রাস্টিয়াল ল্যান্ড হিসাবে নথিভুক্ত করতে হবে। জমিটার তিন কিলোমিটারের মধ্যে একখানি বাওড় আছে। শ্রীদাশ বলেছেন লোকাল পার্টিগুলোকে টাকা খাইয়ে দেবে, সরকারি অফিসে ঘুষবাবদ আপাতত লাখখানেক টাকার একটা ফান্ড বানানো হল। কিন্তু সরকারি অফিসে ঘোরাঘুরি শুরু করতে গিয়ে বিপত্তি বাধল। জমি আন্দোলনে বাংলা উত্তাল, আজ এখানে অবরোধ তো কাল সেখানে বন্ধ। ল্যান্ড ডিপার্টমেন্টের সামনে গিয়ে দেখেন ধর্না চলছে, শিল্পন্নোয়ন নিগম অবধি পৌঁছতেই পারলেন না, ক্যান্টনমেন্ট স্টেশানে অবরোধ ইত্যাদি। শ্রীশর্মা আপাতত জামশেদপুরে ফিরে গেলেন।
যে সমস্যার সমাধান নিজের হাতে নেই, তা নিয়ে অধিক চিন্তিত না হয়ে, শ্রীচ্যাটার্জি ঠিক করলেন কোনও ভালো সিনেমা দেখবেন হলে গিয়ে। বহুকাল হল হলে গিয়ে বাংলা বই দেখা হয় না। মা-বাপ-ভাই-বেরাদর সকলকে নিয়ে যাওয়া স্থির হল। দুটি অ্যামবাসাডার ভাড়া করা হল। ব্যারাকপুরস্থ অতীন্দ্র প্রেক্ষাগৃহে ‘রক অন’ সিনেমাটি দেখবার কথা সকলে বললেন। শ্রীচ্যাটার্জি বাংলা সিনেমা দেখবার বাসনা ত্যাগ করলেন, ফেরার পথে দাদাবউদির-বিরিয়ানির দোকানে বসে বিরিয়ানি এবং মাটন চাপ সহযোগে ডিনার সারলে সকলে। সিনেমা দেখতে দেখতে জীবনের অপূর্ণতা, প্রেমের চিরকালীনতা প্রভৃতি মামুলি চিন্তার মধ্যে শ্রীচ্যাটার্জি নিজেকে ডুবিয়ে ফেললেন। অ্যামবাসাডারের কাঁচ নামিয়ে হাওয়া খেতে খেতে বাড়ি ফেরার পথে ভাবলেন, ব্যবসা দাঁড়িয়ে গেলে মাকে একখানা পূজার ঘর গড়ে দেবেন, হাতে আরও টাকাপয়সা এলে দুর্গাপূজাও শুরু করা যায়। ঘরে ফিরে মোবাইল অন করে দেখেন শ্রীশর্মা ও শ্রীদাশের মিসড কল। তিনি পালটা ফোন করলে পরদিনই তাঁকে পার্ক হোটেলে আসতে বলে দেওয়া হল।

শ্রীচ্যাটার্জি শেয়ালদা স্টেশানে নেমে ট্যাক্সি নিলেন, সুরেন ব্যানার্জি রোডের গোড়ায় ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ। মিছিল পাস করছে, মেট্রো চ্যানেলে, ধর্মতলায় ধর্না চলছে। এসবের থেকে দূরে থাকতে শ্রীচ্যাটার্জি ট্যাক্সির কাঁচ তুলে দিলেন। কুড়ি মিনিটের পথ পৌঁছতে সময় লাগল তিনঘণ্টা। এবার আর রেস্টুরেন্টে নয়, তিনবন্ধু মিলে বসলেন শ্রীশর্মার হোটেলের ঘরে। সাদা ধবধবে চাদর, মসলিনের পর্দা এসির হাওয়ায় উড়ছে। শ্রীশর্মা কোর্টপ্যান্ট পরে বিছানার উপর জুতো তুলে দিয়ে বসেছিলেন, শ্রীদাশের হাতে হুইস্কির গ্লাস। খাটের এককোনায় বসলেন শ্রীচ্যাটার্জি। অবাক হয়ে বললেন, শহরে কবে এলি, জানলাম না তো! স্মিত হাসলেন শ্রীশর্মা। শ্রীশর্মা তাঁর নরম নিচু গলায় বললেন, একটা চিজ তোমার জানা দরকার, যে স্কেলে তুমি ইন্ডাস্ট্রিটা ভাবছ অত ছোট স্কেলে করলে হবে না।
পাশ থেকে শ্রীদাশ বললেন, পটাটো চিপসের কারখানাতেও পঞ্চাশ কোটির ইনভেস্টমেন্ট থাকে। শ্রীশর্মা হাত তুলে বললেন, ধীরে দাশ, ধীরে। শ্রীচ্যাটার্জির শ্রীশর্মার ভঙ্গি সুবিধার ঠেকল না, তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কেয়া হুয়া ইয়ে তো বোলো।
শ্রীশর্মা জানালেন, তিনি বড় ইনভেস্টার খুঁজে পেয়েছেন। ইনভেস্টার শর্ত দিয়েছে, তিনজনের বেশি পার্টনার নয়, শেয়ারহোল্ডার-ডিরেক্টর কিচ্ছু না। শ্রীচ্যাটার্জিকে তাই সরে যেতে হবে। এই কোম্পানিতে তাঁর থাকা হবে না। জমি বাবদ যে টাকা তিনি দিয়েছেন, ই-জাঙ্ক সেটাকে লোন হিসেবে দেখছে ও সুদসহ ফেরত দিয়ে দেবে। এন্ড অফ স্টোরি।

শ্রীচ্যাটার্জি শান্তভাবেই শ্রীশর্মার হোটেল রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। আকণ্ঠ মদ খেতে খেতে সে রাতে শুধু ভেবেছেন দুই শত্রু কী করে মিলে গেল আর তিনি গড়াগড়ি খেলেন! নেশা কেটে যাওয়ার পর থেকে শুধু ভেবেছেন কীভাবে তিনি এর বদলা নেবেন। টেকনোলজি সব তাঁর, বেসিক আইডিয়া ছাড়া আর কিচ্ছুটি কেউ জানে না, বানাক কারখানা পারলে, যদি বানাতে পারে। ভেবে নিশ্চিন্ত হয়ে যেইমাত্র সিগারেট ধরিয়েছেন, মনে হল, মরুক ব্যাটারা, তাঁর স্বপ্নের কী হবে! বাড়িতে এসব নিয়ে আর কিছু বলেননি। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনকে দুঃখ করে বলে ফেলেছেন, লোকাল শাসকদলের এক নেতা, তাঁর সম্পর্কে পিসে। তিনি বলেছেন, চলো একবার রাইটার্স, প্রেসের সামনে বলবে — ওয়েস্টবেঙ্গলের আনরেস্ট দেখে ফিরে যাচ্ছ। পুরনো কোম্পানিতে একটা ইমেল করেছেন, এতদিনে যদি তারা উপযুক্ত লোক না পেয়ে থাকে… তখনই ইনবক্সে খুঁজছিলেন, সেই প্রাক্তন প্রেমিকাটিকে, যার এখনও বিয়ে হয়নি, ইমেল আইডি যদি পুরানো ইমেল থেকে পাওয়া যায় তো খোঁজখবর নেওয়া যায় আর কী।

রাজর্ষি দাশ ভৌমিক

রাজর্ষি দাশ ভৌমিক (জন্ম ১৯৮৭) জলবায়ু-বিজ্ঞানের গবেষক। তিনটি কবিতার বই ও একটি গল্পের বইয়ের লেখক। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত 'শান্তা বসু স্মৃতি পুরষ্কার'-এর প্রথম বছরের প্রাপক।

Read Next: দুঃ

  • বঙ্কিমী ঢঙে পাঠকের সাথে সরাসরি কথা বলার জন্য নাক কুঁচকে পড়তে শুরু রু করেছিলাম। কিন্তু অলিপাবের প্রথম বৈঠক থেকে নাক নিজেই সোজা হয়ে গেছে দেখলাম। এমন গল্প রোজ হয় না, জানি। তবু মাঝে মাঝে পড়তে পেলে খুব ভালো লাগে। শুভেচ্ছা।

  • শ্রীচ‍্যাটার্জী যদি দাড়িগোঁফ লাগিয়ে ‘জীবনমৃত‍্যু’ স্টাইলে ফিরে আসতেন? Jokes apart, ভাষার টানেই এক চুমুকে খতম। শুভেচ্ছা রইল!

Join the Discussion

Your email address will not be published. Required fields are marked *