রাত প্রায় এগারোটা। ডিনার সেরে স্বামী-স্ত্রী দুজনে শুতে গেল। স্বামী প্রতাপ ঘোষ, ভবানীপুরের লোক। তার স্ত্রীর ভাষায় ‘খাস কলকাত্তাইয়া’। ওদিকে স্ত্রী নিভা প্রবাসী বাঙালি। বিহারের ভাগলপুরে মানুষ। জীবনে প্রথম কলকাতা দেখল এই বিয়ের পরে। গতমাসে ওদের বিয়ের একবছর হল। এই একবছরে সে অনেক নতুন জিনিস জেনেছে, অনেক কিছু নতুন শিখেছে। শুধুমাত্র যেটা পুরোপুরি আয়ত্তে আনতে পারেনি, সেটা হল বাংলা ভাষা। তার কথাতেই ধরা পড়ে প্রবাসী ছাপ।
একদিন রাতের ঘটনা। খাওয়াদাওয়া সেরে সবে শুতে গিয়েছে প্রতাপ। নিজের টুকিটাকি কাজ সেরে নিভাও ঘরে এল।
বিছানায় প্রতাপের পাশে শুয়ে নিভা স্বামীকে জিজ্ঞেস করল, শোনো না, একটা জিনিস অনেকদিন থেকে বলার কথা ভাবছি।
– কী ?
– একবছর হল আমাদের বিয়ে হয়েছে। আমি যে তোমার ঘর-বার সামালছি, তোমার ধেয়ান রাখছি, তাতে তুমি খুশি আছ তো? কী মনে হয়, আমি ঠিকঠাক তোমার সাথ নিভিয়েছি?
– ভেবে দেখি, আপাতত আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ো। কাল অনেক ভোরে উঠতে হবে।
নিভা আলো নিভিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ল।
সেদিন প্রতাপ অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি ফিরেছিল। নিভা প্রতাপকে দেখে একটু চমকে গিয়েছিল। চিরদিন দেখেছে প্রতাপ ন’টার আগে বাড়ি ঢোকে না। কখনও আগে এসে গেলেও পাড়ার মোড়ে আড্ডা মেরে ন’টা বাজিয়ে বাড়ি ঢোকে। কিন্তু সেদিন সে সাড়ে ছ’টায় বাড়ি ফিরে এল। অবাক হলেও, খুব আনন্দ হল নিভার। দরজা বন্ধ করতে করতে সে বলল, আরে, আজ এত জলদি জলদি চলে এলে।
প্রতাপ বিশেষ কিছু না বলে গম্ভীর স্বরে ‘হুম’ বলে বেডরুমে ঢুকে গেল। নিভা তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে চলে গেল চায়ের জল চাপাতে। রাতের জন্য সে মাংসের ঘুগনি করছিল। সেটাও সবে রান্না করা শেষ হয়েছে। নিভা ঠিক করল জলখাবারে প্রতাপকে এক কাপ চায়ের সাথে গরম গরম এক বাটি মাংসের ঘুগনি দেবে।
প্রতাপ গা ধুয়ে বেরিয়ে এলে, নিভা ট্রে-তে গরম গরম চা আর ঘুগনি নিয়ে ডাইনিং টেবিলে সাজিয়ে রেখে বসল। প্রতাপ বাটিতে দেওয়া ঘুঘনি দেখে সেটা চামচ দিয়ে অল্প নাড়তে নাড়তে জিজ্ঞেস করল, “এটা কী?”
– তোমার পসন্দিদা ডিশ।
– আরে সে তো অনেক কিছুই খেতে পছন্দ করি। এটা কোনটা?
– এটা মাংসের ঘুগনি হচ্ছে।
প্রতাপ সবে এক চামচ মুখে তুলতে যাবে, সঙ্গে সঙ্গে নামিয়ে রেখে দিল প্লেটে। গম্ভীর মুখে বলল, হচ্ছে? এখনও হয়নি? থাক তবে। আগে হয়ে যাক তারপর খাব। এখন চা-ই খাই।
নিভা বুঝল না ভুলটা কোথায় ‘হচ্ছে’!
অনেকদিন ধরেই নিভা ভাবছিল প্রতাপকে বলবে, কিন্তু কিছুতেই কথাটা বলা হয়ে উঠছিল না। পাশের বাড়ির মাসিমারা আগ্রা-দিল্লি ঘুরতে গিয়েছেন। ওরও ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছিল।
যথারীতি, রাতে খেয়ে দেয়ে শুতে যাবার আগে নিভা সাহস করে প্রতাপের কাছে কথাটা পাড়ল।
– শুনছ, একটা কথা ছিল।
– হুম, বলে ফেলো।
– বলছিলাম… আমাদের বিয়ের পরে সেই যে ভাগলপুর থেকে এখানে এসেছি, তারপর থেকে তো কোথাও যাইনি।
– তো?
– না, মানে আমাকে তুমি তাজমহলে ঘুমাতে নিয়ে যাবে?
– তাজমহল? তা কী করে হবে? ওখানে অলরেডি একজন ঘুমাচ্ছে। আরেকজনের জায়গা হবে বলে মনে হয় না। আপাতত এই ঘরে এই বিছানায় অ্যাডজাস্ট করে নাও, পরে দেখি কী করা যায়
প্রতাপ সিগারেটটা শেষ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। নিভাকে বলল টিভিটা বন্ধ করে দিতে। সোনি মিক্সে তখন একটা গান দেখাচ্ছিল ‘যো ওয়াদা কিয়া ও নিভানা পড়েগা…’
ছবি – লেখক
[সুতীর্থ দাসের এই সিরিজটি তাঁর ফেসবুক টাইমলাইন থেকে অনুমতিক্রমে প্রকাশিত। আশা করা যায়, আরও কয়েকটি পর্বে প্রতাপ আর নিভার গপ্পো আমরা পাব।]
Join the Discussion