A+ A-

আমার ঝাড়গ্রাম (শেষ পর্ব)

মিশকালো কয়লার ইঞ্জিন, কাঠের বগি, ডায়মন্ডহারবার লোকালে ছেলেবেলায় পিসির বাড়ি বেড়াতে যেতাম। বারুইপুরের পরের স্টেশন কল্যাণপুর, সিঙ্গল লাইনে। স্টেশন থেকে বেরোলেই মন ভালো, অবারিত মাঠ, গগন ললাট। কত সবুজ। পিসির বাড়ি যাওয়ার দিন মানে মনে মনে পাখি হওয়ার দিন। ট্রেনে উঠেই জানালায় গিয়ে দাঁড়াতাম। পিছনে ছুটে যাওয়া দৃশ্যগুলি কখনও পুরনো হত না। নামতাম যখন, কয়লার গুঁড়োর পুরু আস্তরণ মুখে, মন জুড়ে মুক্তির আলো।
দেড় বছর ধরে প্রতি সপ্তাহে ইস্পাত এক্সপ্রেসে ঝাড়গ্রাম যাত্রা সেই কিশোরবেলার আলোকিত অনুভূতিমালা ফিরিয়ে দিয়েছিল। ট্রেন খড়গপুর ছাড়ার পর ডানদিকের একটা জানালা আমার চাই। কলাইকুণ্ডা এয়ারবেসে ধূসর মিগ বিমানটা কেমন বিশ্রাম নিচ্ছে, দেখতে হবে না? সকালে তার সঙ্গে ভাব, কিন্তু রাতে ভারী রাগ ধরাত। কলেজের উলটোদিকে মেস-প্রবাসী সহকর্মীদের সঙ্গে ক্যানালের ধার ধরে জঙ্গলের দিকে বেড়াতে যেতাম। তখন এই বিমানটা টহল দিতে বেরিয়ে বিকট শব্দ করে মাথার ওপরে চক্কর কাটত আর বারবার গায়ে আলো ফেলত। আকাশের দিকে চেয়ে তুমুল গালাগালি দিত কেউ।

কলাইকুণ্ডা ছাড়িয়ে ট্রেন যত এগোয়, প্রকৃতির সাজবদল ক্রমশ প্রকট। পরের স্টেশন খেমাশুলি লাল মাটির লো লেভেল। অদূরে হাইওয়ে। পথপাশে গুপ্তমণির মন্দির। ট্রেন না থামলেও প্রতিটা বাস ও গাড়ি থামে। জানালা দিয়ে চালক, কন্ডাকটর ও যাত্রীরা মুঠো মুঠো পয়সা ছুড়ে দেন। মন্দিরে অন্তত ১৫-১৬ জন লোক থাকে সবসময়, ছুটে ছুটে পয়সা কুড়নোর জন্য।

এরপর সরদিয়া স্টেশন। লাগোয়া জনপদের নাম মাণিকপাড়া। ক্রমশ শালের জঙ্গল ঘিরে ধরে। আলোছায়ার আশ্চর্য আলপনার ভেতর দিয়ে অনাবিল আনন্দযাত্রা। গভীর শালবনের ভেতরে বাঁশতলা স্টেশন। ট্রেন থামত না বলে বাঁচোয়া। নয়তো নেমেই যেতাম। ছুটে চলে যেতে সাধ হত রহস্যময় বনপথে। বাঁশতলা আমার দেখা সমতল ভারতের সবচেয়ে সুন্দর স্টেশন। তারপর শালবন কিঞ্চিৎ পাতলা হল মানে উঠতে হবে, ঝাড়গ্রাম এসে পড়ল। স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে রিকশায় কলেজের দিকে। বিচিত্র ধরনের খাবার পাওয়া যেত, যা অন্য কোথাও দেখিনি। নোনতা গাঁঠিয়া ও শুকনো বোঁদের ফিউশন, শালপাতার ঠোঙায় পরিবেশিত। সব মিলিয়ে ঝাড়গ্রাম আমার একা-একা দুর্গা দিদির হাত ছাড়ানো অপু হয়ে দেশ আবিষ্কারের প্রথম আনন্দপাঠ।

আমার ঝাড়গ্রাম

চিলকিগড়, শিলদা, বেলপাহাড়ি, ঘাঘরা, কাঁকড়াঝোড়, কত অনুপমা প্রকৃতির সৌন্দর্যবিন্দু ঝাড়গ্রামকে ঘিরে। কী খেয়াল হল, এক ছুটির দিনে বাসের গায়ে অচিন গাঁয়ের নাম লেখা দেখে উঠে পড়লাম। ক্রমে লোকজন, মালপত্র, হাঁস-মুরগিতে ঠাসাঠাসি ভরে উঠল। সাজ-পোশাকে একমাত্র ভদ্রলোক আমিই। গাড়ি ছাড়ার আগে কন্ডাকটর উঠেই দেখতে পেল। জানতে চায়, কোথায় যাব?
“ওই যে বাসের গায়ে লেখা ওদলচুয়া, ওখানেই।”
“সে তো বহু দূরের গ্রাম। হেলথ সেন্টারে চাকরি পেয়েছেন? নতুন ডাক্তারবাবু?”
“ওসব কিছু না। নাম দেখে ভালো লেগেছে। বেড়াতে চললাম। তোমাদের বাস যাচ্ছে যখন, তখন ফিরবেও। চলে আসব।”
“আজ তো ফিরব না! কাল ভোরে ফিরব।”
“আমিও তাহলে তাই। বাসে রাতে থেকে যাব। তোমরা যা খাও, তাই খেয়ে নেব।”
লোকটি আকাশ থেকে পড়ল। আমার হাবভাব দেখে পাগল লাগছে না। মাথা চুলকে ভিড় ঠেলে চালকের কাছে গিয়ে কী সব বলে এল। চালক উঠে এল। বলে, “দাদা, ওদলচুয়া গ্রামটি ভারী সুন্দর। চারদিকে ছোটো ছোটো পাহাড়। মধ্যিখানে বাটির মতো উপত্যকায় কয়েক ঘর আদিবাসীর বাস। কিন্তু আপনার মতো শহরের লোক সেখানে থাকতে পারবে না। নিরাপদও নয়। আমরা খানিক দূরে এক ভাটিখানায় বেঞ্চি জুড়ে তাইতে শুয়ে রাত কাটাই। আপনি দয়া করে যাবেন না।”
অন্য যাত্রীরাও একই কথা বলতে লাগলেন। কী আর করি, তিন-চার স্টপেজ পার হয়ে আমার ভাড়াবাড়ির কাছে নেমে পড়লাম। নেমেই দেখি পিছনে কলেজের এক সহকর্মী। বাইক থামিয়ে সহাস্য প্রশ্ন, “কোথায় গিয়েছিলে ভায়া?”
পুরো গল্প তাঁকে বললাম। বললেন, “কাজ নেই যখন, চলো আমার শ্বশুরবাড়ি।”
বাইকের পিছনে আসীন হলাম। সোজা গোপীবল্লভপুর। সে রাতে যত বড় চিংড়ি খেয়েছিলাম, অধ্যাপক জামাইয়ের আদরের ভাগ হিসাবে, তত বড়ো ওই প্রাণী বাকি জীবনে আর দেখিনি।

লজ্জার ঘটনাটি ঘটল পরদিন সকালে ভাড়াবাড়িতে ফিরে। পাশের ঘরগুলিতে বাড়িওয়ালা থাকতেন। ওরা তিনজন, কাকু-কাকিমা ও তাঁদের মা-কে ঠাকুমা বলতাম। বেড়ার গেট ঠেলে সামনের মাঠে ঢুকতেই তিনজনে ছুটে এলেন। প্রশ্নবাণে জর্জরিত, কোথায় গিয়েছিলাম? কোথায় ছিলাম সারা রাত? চিন্তায় তাঁদের সারারাত ঘুম হয়নি। এমনকী যে ছেলেটি সারদা হোটেল থেকে খাবার দিতে এসে ফিরে গিয়েছিল, সেও সকালে এসে খোঁজ নিয়ে গিয়েছে। লজ্জায় অধোবদন হয়ে ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখি, যে গোসাপটি আমার বাথরুমের ঘুলঘুলিতে সুখে-শান্তিতে বসবাস করে, সেও চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে।
মাত্র দেড় বছরে ঝাড়গ্রামে যত মায়া রেখে এসেছি, ছোট্টো বুকের মধ্যে আর একটু পরিসর পেলে মহীরুহ হয়ে কবেই আকাশে ডালপালা মেলে দিত।

আমার ঝাড়গ্রাম

বিরাট মাঠের শেষ মাথায় একতলা বাড়ি। তিনদিক অনেকটা করে খোলা। পত্রমর্মরের দেশে হাওয়া খেলার ময়দান। বাড়ির সামনে আবার ছাদহীন বর্গাকার রোয়াক। সারাবেলা চড়ুই-শালিকের দল এক্কাদোক্কার মজায় মেতে থাকত। বিকেলে কলেজ থেকে ফিরে হাওয়া খেতে বসতাম। বাড়িওয়ালা কাকু-কাকিমা ও ঠাকুমার সঙ্গে সাত রাজ্যের গল্প। তখনই সে আসত। সামনে বেড়ার গেট ঠেলে নয়, পিছনদিকে রাংচিতার বেড়া লাফিয়ে পার হয়ে। আড়চোখে দেখতাম আমার লোকাল গার্জেনদের কপালে হঠাৎ ভাঁজ। চোখে না বলা প্রশ্ন, ‘এ মেয়ে কেন রোজ আসে?’ মজা লাগত। কলেজেও সহকর্মীদের মধ্যে মৃদু কানাঘুষো, গা-ঠেলাঠেলি। নবনিযুক্ত দুই প্রায় সমবয়স্ক অধ্যাপক-অধ্যাপিকার মধ্যে সম্পর্ক কতখানি গভীর হল, তা নিয়ে হালকা আলোচনাও কানে আসে। দুজনে কলকাতার। একই দিনে চাকরিতে যোগদান। হাওড়া-ঝাড়গ্রাম এক ট্রেনে যাতায়াত। কৌতুক বোধ করতাম সকলের কৌতূহলে।
বিকেলে সে এসেই তাড়া দিত, “চলো চলো, দূষণহীন এমন শহর আর পাবে না। যতদিন আছি অক্সিজেন ভরে নিই। অনেক হাঁটব আজ।”
বেরিয়ে পড়তাম। ঝাড়গ্রাম শহর ছাড়িয়ে অনেক দূর পর্যন্ত হেঁটে আসতাম। কত কথায় ও নীরবতায় সন্ধে গড়িয়ে যেত রাতের দিকে। ফেরার পথে বাজার করা। এটাই আমাদের রুটিন ছিল। খিদে পেলে ‘ছিমছাম’ নামে মিষ্টির দোকানে কিছু খাওয়া। ওদের সঙ্গে ভাব হয়ে গেল। দোকানে বসে ভাব বিনিময় হত জঙ্গলমহল ও কলকাতার। বৃষ্টির দিনগুলোতে ঘরে বসে নির্ভেজাল আড্ডা। ধারাপাত ধরে এলে কখনও ছাতা মাথায় শাল জঙ্গলের সদ্যস্নাত রূপ দেখতে যাওয়া।
এক বছরের মাথায় কলকাতার কলেজে চাকরি পেয়ে সে সরকারি কলেজের চাকরি ছেড়ে চলে গেল। আমার জন্য ঝাড়গ্রামে সহমর্মিতার ঢল নামল, যেন চাঁদ হারিয়ে অমাবস্যার আকাশ হয়ে গেছি। দেখতাম আর মজা পেতাম। এক বিকেলে ‘ছিমছাম’ দোকানের মালিক কথা প্রসঙ্গে বললেন, “আপনাদের দুজনকে আর একসঙ্গে দেখা যায় না বলে ভালো লাগে না।”
“কেন? আমরা তো কেউ কারও বিশেষ কেউ ছিলাম না?”
“সে জানি। তাও…”
“কী তাও?”
“খুব ভালো বন্ধু ছিলেন আপনারা।”
“বন্ধুত্ব কি কখনও অতীতকাল হয়? স্বার্থহীন আসক্তিহীন দেওয়া-নেওয়াগুলো তো চিরকালীন।”
“আপনিও কি চলে যাবেন?”
“যাব। কিন্তু তাই বলে আপনাকে, আপনার দোকান ও নিজের হাতে বানানো মিষ্টির গুণমান কি ভুলে যাব?”
“ও বুঝেছি!”
“কী বুঝেছেন?”
অবাক করে দিয়ে ভদ্রলোক যা বললেন, তা আমার অতি উচ্চশিক্ষিত কোনও সহকর্মী কোনওদিন ভাবতেও পারেননি মনে হয়, “স্মৃতিই আমাদের সবচেয়ে বড়ো বন্ধু। স্মৃতি কখনও হারায় না।”

আমার ঝাড়গ্রাম

সেই ১৯৯৬-৯৭ সালে ঝাড়গ্রামে নাশকতামূলক রাজনীতির প্রাদুর্ভাব দেখিনি। কিন্তু রাজনীতির আকাশ ঘোলাটেই ছিল। খুন, জখম, সংঘর্ষ লেগে থাকত। বিনা নোটিশে বনধ ডাকা হত। কলেজে তার আঁচ আসত না এমন নয়। অনেক জঙ্গি ছাত্রনেতা ছিল। পাশ করে বেকার, অথচ দাদাগিরির পুরনো অভ্যাস ছাড়তে পারেনি, এমন প্রাক্তন ছাত্ররাও নেতাগিরি দেখানোর সুযোগ পেলেই কলেজে চড়াও হত। ফলে ছাত্রভর্তি থেকে শুরু করে নানা ছুতোনাতায় তাদের আন্দোলন চলত। কলেজ ইউনিয়নের ভোটে এমন উত্তেজনা যে, পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে দিত। ছাত্রদের দাবি আদায়ের একটি বড়ো উপায় ছিল শিক্ষকদের ঘেরাও করা। নিয়ম করে ঘেরাও হয়ে যেতাম। অধ্যক্ষের ঘরে আরামদায়ক চেয়ারে আটকে থেকে বেলা বয়ে যেত। আমরা নতুন শিক্ষকরা মজা পেতাম। ভাড়াবাড়িতে গিয়ে শুয়ে-বসে সময় কাটানোর থেকে অনেক ভালো। অন্যরকম অভিজ্ঞতা, উপরন্তু আড্ডার পরিবেশ। পিছনের সারিতে বসে নিচু গলায় গুনগুন ফিসফাস। অধ্যক্ষ মশাই তিতিবিরক্ত অবস্থায় মাঝে মাঝে কটমট করে চাইতেন। কিন্তু প্রথম সারিতে বসা মাতব্বর সহকর্মীরা পরম স্নেহে অর্বাচীনগুলিকে আগলে রাখতেন। একবার ছাত্র-শিক্ষক রফাসূত্র ভেস্তে গেলে ছাত্ররা প্রিন্সিপ্যালকে চেয়ারসুদ্ধু তুলে নিয়ে গিয়ে মাঠে শালগাছের ছায়ায় বসিয়ে দিয়ে এল। আমরাও পিছনে পিছনে গেলাম। একটু পরে জঙ্গি নেতারাই একঘণ্টা আন্দোলন স্থগিত রেখে মাংস ভাত নিয়ে চলে এল। সংগ্রামের পিকনিক ব্রেক বোধ হয় ঝাড়গ্রামেই সম্ভব।

প্রতিটা ঘেরাও আন্দোলনের পর দাবি আদায় হয়ে গেলে নেতারা সদলবলে শিক্ষকদের কাছে এসে ক্ষমা চেয়ে যেত। সিনিয়র সহকর্মীদের দেখেছি, সহাস্যে তাদের পিঠে কিল মেরে বলছেন, “খুব বাড় বেড়েছিস। বোস বোস, চা খা।”
একবার হল কী, সম্ভবত ভর্তি নিয়ে ঘেরাও চলছে। রাত ন’টার পরেও গিঁট খোলার নাম নেই। বাধ্য হয়ে অধ্যক্ষ পুলিশ ডাকলেন। মহকুমার এক উচ্চপদস্থ পুলিশ আধিকারিক বিশাল বাহিনী নিয়ে হাজির। প্রিন্সিপ্যালের ঘরে ঢুকে ত্রিপাক্ষিক আলোচনায় বসলেন। হঠাৎ মাথাগরম করে পুলিশ অফিসার প্রিন্সিপ্যাল ও সিনিয়র অধ্যাপকদের উদ্দেশে বলে উঠলেন, “আপনারা তো সব ‘হ্যালো বম্বে’ করা লোক। নিজেদের বিপদ নিজেরাই ডেকে এনেছেন।”
তখন দু-চারজন শিক্ষকের স্বভাবদোষের জন্য মজা করে ‘হ্যালো বম্বে’ কথাটি প্রচলিত ছিল। তাঁরা ইস্পাত এক্সপ্রেসে আসতেন। কলেজে ঢুকে চা জল খেয়ে স্টেশনে ফোন করতেন, “হ্যালো, বম্বে এক্সপ্রেস কি আজ রাইট টাইম?” উত্তর ‘হ্যাঁ’ হলে তখনই রিকশা নিয়ে আবার স্টেশনে। লেট থাকলে হেলেদুলে ক্লাসে। কিন্তু সেই তকমা সবাইকে পরিয়ে দেওয়া অনুচিত। খুব রাগ হল পুলিশ অফিসারের এমন দায়িত্বহীন কথা শুনে। সহকর্মীরাও রেগে গেলেন। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ক্ষেপে গেল উপস্থিত ছাত্রনেতারা। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বেমক্কা বলে দিল, “যান, এখনই কলেজ থেকে বিদেয় হোন। শিক্ষকদের অপমান করার জন্য আপনাদের ডাকা হয়নি। কলেজের সমস্যা ঠিকই মিটে যাবে, কিন্তু বাইরের লোকের মাতব্বরি হজম করা হবে না।”

অফিসার প্রিন্সিপ্যালের দিকে তাকালেন। তিনি চোখের ইশারায় দরজা দেখিয়ে দিলেন।

আমার ঝাড়গ্রাম

পুজোর ছুটি ফুরিয়ে গেল ১৯৯৭ সালের। ইতিমধ্যে নিয়োগপত্র পেয়েছি বিশ্বভারতী থেকে। রিলিজ অর্ডার বেরোচ্ছে না বলে অপেক্ষারত। ঝাড়গ্রামেই আছি, কিন্তু কোথায় যেন মনকেমন চিনচিন করছে। ছাত্র-ছাত্রীরা মনমরা। বিকেলে বাড়িতে আসে, কিন্তু আগের মতো কেউ আনন্দ করে না। প্রকাশ সবচেয়ে দুঃখিত। ছুটির দিনে সকাল থেকে এসে গোমড়া মুখে বসে থাকে। বলি, “চলো ঘুরে আসি কোথাও থেকে।”

প্রিয় ছাত্র পিছনে বসিয়ে বাইকে স্টার্ট দেয়। গভীর শালবন পার হয়ে বিস্তীর্ণ টাঁড়। সিঁদুরে মাটির আদিগন্ত উথালপাথাল। উদাস বাউলের মতো হেমন্তের আলখাল্লা ওড়ে এলোমেলো মনকেমনের হাওয়ায়। ডুলুং নদীর ঝিকিমিকি নীল নকশা পার হয়ে পৌঁছে যাই দিগন্তলীন গাঁয়ে। মাদল বাজছে দিনমানে। ভিড় জমেছে মাঠে। গিয়ে দেখি ফুটবল খেলার আসর। হাতে লেখা ব্যানারে বড় বড় করে লাল কালিতে লেখা: ‘চ্যাম্পিয়নের পুরস্কার খাসি। রানার্স আপের পুরস্কার তিনটি মোরগ।’

খানিক খেলা দেখে আবার নতুন রাস্তায়। মাইকে ফুঁকে যায়, ‘বিকেলে অমুক গ্রামে মোরগ লড়াই। দলে দলে আসুন। পছন্দের মোরগে বাজি ধরুন।’

বাইকের পিছনে বসে ভাবি, আমার বাংলার ভেতরে এ আরেক বাংলা। ঝাড়গ্রামে পড়াতে না এলে যার খবরই পাওয়া হত না। একই অনুভূতি হল এই সেদিন কোচবিহারের কুচলিবাড়ি গিয়ে। সানিয়াজান নদীধোয়া এই বাংলার প্রান্তিক জনপদ, যার তিনদিক ঘিরে আমাদের খণ্ডিত হৃদয় বাংলাদেশ। কিন্তু কেন এই বাংলা অচেনাই রয়ে যায়? ট্রান্স হিমালয়ে না হয় উত্তুঙ্গ পর্বতের বাধা আছে বলে অতি দুর্গম। মৌসুমি মেঘ পর্যন্ত ওপারে গিয়ে বৃষ্টি নামাতে পারে না। তাই লাদাখ, জাঁস্কার, স্পিতির শীতল মরুভূমি অবশিষ্ট ভারতের থেকে অনেকটাই আলাদা। কিন্তু আমার বাংলায়? এখানে বাধা আমার মন। শিক্ষিত শহরবাসী হবার কৃত্রিম অহংকার। নিজেকেই প্রশ্ন করি, তাহলে আসলে কে প্রান্তিক, খাসি জেতার আশায় খেলতে নামা বা মোরগের লড়াইয়ে বাজি ধরা মানুষগুলি? না আমি?

চিন্তার জাল ছিঁড়ে যায়। এক অচিন গ্রামে তেরাস্তার মোড়ে বাইক থামায় প্রকাশ। সামনে দেখি ফিরিওয়ালাকে ঘিরে গ্রামের মহিলা ও কচিকাঁচাদের ভিড়। প্রকাশ আমার দিকে ফিরে হাসছে, আজকের দিনে এই প্রথমবার। বলে, “স্যর আপনাকে একটা জিনিস খাওয়াব; আমাদের ভুলে গেলেও সারাজীবন মনে রাখবেন।”
ফিরিওয়ালার সামনে প্রকাশের দেখাদেখি হাত পাতি। শালপাতার দোনায় পরিবেশিত হয় হাকুচ টক গোঁড়া লেবুর রস, সন্ধক লবণ ও লঙকা গুঁড়োর মশলা সহযোগে পিঁপড়ের ডিম। আমার বাংলার রূপ-রস-গন্ধে জারিত হেমন্তের আশ্চর্য সে দিনটা সত্যি আমরণ ভোলা যাবে না।

আমার ঝাড়গ্রাম

প্রিয় অরুণাভবাবু, হয়তো আমাকে মনে নেই। আমার নাম অংশু পাল পুরকায়স্থ। কয়েক বছর আগে, আপনি তখন ‘ভ্রমণ’-এর সাব-এডিটর, আমার প্রথম লেখা ও ছবি ছেপেছিলেন। লেখা জমা দিতে গিয়ে আপনার সুন্দর ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছিলাম। গত কয়েকমাসে আপনাকে ৩-৪ বার বিকাশ ভবনে দেখেছি। কেমন উদভ্রান্তের মতো থাকেন। মনে হয় কোনও সমস্যা নিয়ে আসেন। অনেক কষ্ট করে আপনার বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করে চিঠি দিলাম। আমি বিকাশ ভবনেই অমুক সেকশনে বসি। দরকার মনে করলে দেখা করবেন। আপনার কোনও কাজে আসতে পারলে ভালো লাগবে।

অভাবনীয় চিঠিটি পেয়েছিলাম ১৯৯৭-এর সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি। তার আগে জুলাইতে চাকরি পেয়েছি বিশ্বভারতীতে। ওরা বলেছিলেন, জয়েন করার সময় একটিই জরুরি কাগজ লাগবে, ওয়েস্ট বেঙ্গল এডুকেশন সার্ভিস থেকে রিলিজ অর্ডার। চাকরি ছাড়ার কথা ঘোষণা করার পর সেই কাগজটি পাওয়ার জন্য সল্টলেকের বিকাশ ভবনে ছোটাছুটি আরম্ভ হল। প্রথমেই জানা গেল, চাকরি শুরুর এক বছরের মধ্যে আমার ফাইল স্থানচ্যুত। খোঁজ চলছে। পাওয়া গেলে রিলিজ দেবার জটিল প্রক্রিয়া শুরু হবে। সময় চলে যাচ্ছে, ডিপিআইয়ের দরজায় কড়া নাড়লাম। তিনি বলে দিলেন, “চাকরি ছাড়বেন কেন? আগামী মাসেই আপনাকে কলকাতার কলেজে ট্রান্সফার করে দিচ্ছি।” আমি নাছোড় দেখে ব্যাজার হয়ে জানালেন, “আসুন এবার, আমার অনেক কাজ।”

তারপর থেকে নিরন্তর দিশাহীন ছোটাছুটি। যখন ভাবছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির সুযোগটা গেলই, ঝাড়গ্রামেই স্থায়ীভাবে থেকে যাই, তখন অংশুবাবু নামে ওই দেবদূতের চিঠি পেলাম। দেখা করলাম। তিনি বললেন, “যান, কদিন মন দিয়ে কলেজ করুন। পুজোতে মজা করুন আর বিশ্বভারতীকে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে বলুন। আমি আপনার রিলিজ অর্ডার করিয়ে দেব।”
পুজোর ছুটি ফুরানোর দুই সপ্তাহের মধ্যে হারানো ফাইল পাওয়া গেল। তার তিন সপ্তাহ পরে আবার রাজ্যপালের বয়ানে লেখা সরকারি চাকরি থেকে রিলিজ অর্ডার বেরিয়ে গেল। সবই অংশুর হাতযশ। মাঝে একবার গিয়েছিলাম কিছু সইসাবুদ করতে। ৯৭-এর ডিসেম্বরে কাগজ হাতে শান্তিনিকেতনে জয়েন করলাম।

অংশু না থাকলে আমার ঝাড়গ্রাম পর্ব এখনও চলত। কারণ, চাকরি দেবার আগে পিএসসির মাধ্যমে সরকার লিখিয়ে নিয়েছিল, দার্জিলিং গভর্নমেন্ট কলেজ ছাড়া আর কোথাও বদলি চাইতে পারব না। তাহলে এই স্মৃতিকথা লিখতে আরও অনেকদিন দেরি হয়ে যেত। এখন অংশুকে আর কোথাও খুঁজে পাই না। হতে পারে, আধুনিক মানুষের ধর্ম মেনে, কাজ মিটে যাওয়ার পর সেভাবে খুঁজিনি হয়তো।

– সমাপ্ত –

আমার ঝাড়গ্রাম

আমার ঝাড়গ্রাম স্মৃতিকথা ১২ পর্বে ফুরলো। লিখব ভেবে লিখিনি। কয়েকদিন আগে ঝাড়গ্রামের নতুন জেলা হবার খবর দেখে মন হল লিখতে, অবসরে মোবাইল খুলে গুগল কিপ-এ লিখে ফেললাম। সেখান থেকে পোস্ট, এডিট না করেই। পরে হয়তো সাজাব। ছোটো-বড়ো করে নেব। কিন্তু এই লেখাই আপনাদের এত ভালো লাগবে, ভাবতে পারিনি। অনেকে জানতে চান, বই করব কিনা। কিচ্ছু ভাবিনি। আসলে ভেবেই লিখিনি। আগামী দিন বলবে স্মৃতিকথার ভবিষ্যৎ কী। ১৯৯৭ সালের পর আর ঝাড়গ্রাম যাইনি। তার জন্য দুঃখ নেই বিন্দুমাত্র। তার যে মহার্ঘ্য ছবিটা আমার মানসপটে আঁকা আছে, সেটা নিয়েই বেশ আছি। আপনাদের সকলকে সেই ছবিটার একাংশ ভাগ দিতে পেরে ভালো লাগছে। শুভেচ্ছা নেবেন।


‘আমার ঝাড়গ্রাম’ লেখাটি সাহিত্যিক ও ভ্রমণপিপাসু অরুণাভ দাস তাঁর ফেসবুক ওয়ালে বারোটি খণ্ডে পোস্ট করেছিলেন। পাইনকোন-এর অনুরোধে তিনি লেখাটি এই সাইটে প্রকাশ করতে অনুমতি দিয়েছেন। এই পর্বে রইল লেখাটির শেষ ছ’টি খণ্ড।

অরুণাভ দাস

অরুণাভ দাসের জন্ম ১৯৭০ সালের অক্টোবর মাসে, কলকাতায়। কর্মজীবন শুরু ১৯৯২-এ ভ্রমণ পত্রিকার সাব এডিটর হিসাবে। ১৯৯৬-৯৭ ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজে লেকচারার। ১৯৯৭ থেকে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় শানিনিকেতনে অধ্যাপনা। ভ্রমণ বিষয়ে কয়েক হাজার ফিচার লিখেছেন এপার ও ওপার বাংলার নানা পত্রপত্রিকায়। ছোটোগল্প প্রকাশিত দেশ, সানন্দা, বর্তমান, সাপ্তাহিক বর্তমান, শুকতারা ইত্যাদি পত্রিকায়। উপন্যাস, ভ্রমণকথা, ইতিহাস মিলিয়ে প্রকাশিত বই ২৮টি। ভ্রমণ আড্ডা থেকে ভ্রমণসম্মান ২০১৪ ও সিকিম এক্সপ্রেস সংবাদপত্র থেকে ট্রাভেল রাইটার অব দ্য ইয়ার ২০১৬ সম্মানপ্রাপ্ত।

Read Next: আমার ঝাড়গ্রাম (১ম পর্ব)

Join the Discussion

Your email address will not be published. Required fields are marked *