A+ A-

পেনেটির সেই রাত

“খিদিরপুরের কাছে নাকি আবার মহারাজা নন্দকুমারকে দেখা গেছে।” কাগজটা মুড়ে রাখতে রাখতে জানালেন শ্যামলকৃষ্ণ।
“কেন গুলিখোরদের লেখাগুলো পড়ে অনর্থক সময় নষ্ট করেন বলুন তো?” সুধীন ভ্রূ কোঁচকালেন।
“তা বললে চলবে কেন দাদা? মহারাজা যে ঘোড়ার গাড়ি করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সে খবর বেরোনোর পর কাগজওলাদের বিক্রিবাটা বেড়ে গেছে রীতিমতন।”
সত্যেন খুব আশাহত মুখে মাথা নাড়লেন, “ভূত অবধি মানবি না তোরা? এই হল গিয়ে আজকালকার নব্য যুবকদের সমস্যা, কী বলেন চারুবাবু?”
চারু দত্ত সমস্যায় পড়ে গেলেন। সত্যেন মজা করছেন, নাকি সত্যি কথাই বলছেন সেটা ঠিক ঠাহর হচ্ছে না। আমতা আমতা করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় অপ্রত্যাশিত ভাবে সাহায্য এল সুধীনের থেকেই।
“সব নব্য যুবক-যুবতীই যে ভূত মানে না, সে কথা কিন্তু বলা যাবে না সত্যেনদা। তোমার পাশে যে বসে আছে তাকে একবার শুধিয়ে দেখো না?”
“সুশোভন মার্ক্সসিস্ট হয়ে ভূতে বিশ্বাস করছে নাকি আজকাল? হ্যাঁ রে, কাস্তে-হাতুড়ির বদলে কি এবার কাস্তে-ক্রস নিয়ে ঘুরবি?”
সুশোভন হাসতে হাসতে বললেন “হাতুড়ির মাথাটা ডান্ডার ওপরে না রেখে মাঝে নামিয়ে দিলেই কিন্তু ক্রস। তবে সুধীন কিন্তু আমার কথা বলছে না সত্যেনদা, তোমার ডানদিকে দেখো।”
সত্যেন মাথা ঘুরিয়ে হৈ হৈ করে উঠলেন, “আরে লীলু যে! তুই এরকম চুপটি করে বসে আছিস যে টেরই পাইনি। ভূত মানিস নাকি?”
লীলা রায় হাসি হাসি মুখে তাকালেন, “খুব মানি সত্যেনদা। ওনাদের কথা অবিশ্বাস করার মতন বুকের পাটা আমার নেই।”
“তাহলে একটা গল্প ধর দিকিন, জম্পেশ করে।”
“গল্প তো জানি না।”
সত্যেন এবার একটু ব্যাজার হলেন, “দূর, মাটি করলি সব! কোথায় ভাবলাম শীতের রাতে একটা জমাটি আড্ডা হবে ভূত নিয়ে।”
লীলা গলা নামিয়ে বললেন, “কিন্তু অনেক সত্যি ঘটনা জানি। বলব?”
এবার বুঝতে পেরে সত্যেন মুচকি হাসলেন, “তাহলে তো কথাই নেই।”

“বেশ। এ হল সেই যে বার কলকাতায় প্লেগ দেখা দিল আর লাখ লাখ মানুষ পালাতে শুরু করল, তখনকার কথা। জ্যাঠামশায় ঠিক করলেন বাড়িসুদ্ধ সবাইকে নিয়ে ময়মনসিংহ চলে যাবেন। মুশকিল হল ঠিক ওই সময়েই ওনার মেজো মেয়ে পুনি মানে পুণ্যলতার জলবসন্ত হল। আর তারপরেই হল গিয়ে মণির, পুনির পরের ভাইয়ের — বাড়ির বাকিদের কিন্তু কিচ্ছুটি হল না। প্রথমে জ্যেঠিমা ঠিক করলেন, ওদের ঢের খানেক জামা কাপড় পরিয়ে নিয়ে চলে যাবেন কেউ টেরও পাবে না। কিন্তু সে প্ল্যান হতে হতে দুজনের মুখেই গুটি ফুটে উঠল আর ওদিকে জ্যাঠামশায়ও বললেন কাজটা অন্যায় হবে। শেষে ঠিক হল জ্যাঠামশায়ের এক গুণমুগ্ধ ভক্তের পেনেটিতে যে বিশাল বাড়িটা ফাঁকা পড়ে আছে, ওরা সেখানে গিয়ে মাসখানেক থাকবে। তারপর অসুখটা একটু কমলেই জ্যাঠামশায় বা ওদের কাকাদের কেউ এসে নিয়ে যাবেন…”
অপূর্ব চন্দ হাত তুললেন, “পেনেটিটা কোন জায়গা?”
“পেনেটি মানে পানিহাটি, আমরা যদিও চিরকাল পেনেটি ছাড়া অন্য কিছু নামে ডাকলাম না। যাক গে, যে কথা বলছিলাম। সব ভাই বোনদের ছেড়ে থাকতে হবে বলে মণির একটু মন কেমন করছিল, পুনির অবশ্য দেখা গেল একা থাকবে বলে বেজায় ফুর্তি। তো এক রোববার বাক্স-প্যাঁটরা বেঁধে জ্যাঠামশায় ওদের দুজনকে রাখতে গেলেন পেনেটির সেই বাড়িতে। গঙ্গার ধারেই বিশাল দোতলা বাড়ি, যদিও মালিক গোয়ালন্দের জমিদার বলে সেখানেই থাকেন। মালিক অবশ্য তার করে জানিয়েছিলেন বাড়ির দেখাশোনা করার জন্য যে কাজের লোক রয়েছে, সেই পুনি আর মণিকে সামলাবে।
“কিন্তু ঝাড়া মিনিট কুড়ি-পঁচিশ ধরে সামনের দরজার লোহার কড়া নেড়ে নেড়ে জ্যাঠামশাইয়ের হাত ব্যথা হয়ে গেল, সে লোকের পাত্তা নেই। আশেপাশেও কারোর টিকির দেখা নেই, জ্যাঠামশাই শেষে দুজনকে দু হাতে পাকড়ে যেই অ্যাবাউট টার্ন নিয়েছেন, দেখেন এক দশাসই মহিলা একটা গরুকে টেনে টেনে নিয়ে আসছে। ওদের দেখেই তাড়াতাড়ি জিভ কেটে ঘোমটা মাথায় দিল। জ্যাঠামশাই একটু গলা খাঁকরানি দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এ বাড়ির কাজের লোকটিকে কোথায় পাওয়া যাবে বলতে পারেন?’
“মহিলা বলল, ‘এজ্ঞে আমিই, এই আমোদিনীকে মাঠ থেকে নিয়ে আসতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল। আমি হলেন গে ঘটুর মা।’
“জ্যাঠামশাই মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনার কথা ওরা আমাকে বলেছে। কিন্তু আরও একজন কেউ আছে না?’
“‘এজ্ঞে নটবরও ছিল অবিশ্যি।’
“‘ছিল মানে? গেল কোথায় তাহলে?’
“ঘটুর মা মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সগগে চলে গেছে সে আজ, মাস দুয়েক হল। বাবুরা না আসা অবধি আমাকে একাই এখন এ বাড়ির দেখভাল করতে হবে।’
“জ্যাঠামশাই একটু ইতস্তত করছিলেন। তাই দেখে ঘটুর মা এবার বলল, ‘আপনি বাবু কোনও চিন্তা করবেন না। বাছারা আমার কাছে দিব্যি থাকবে।’
“তারপর পুনি আর মণির দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে বলল, ‘চলো বাছারা, তোমাদের জন্য নিমপাতা জোগাড় করি গে।’
“জ্যাঠামশাই এবার একটু আশ্বস্ত হলেন। পুনি-মণিদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘দৌরাত্ম্য করবে না, কেমন? গড়পার থেকে তোমাদের খোঁজ নিতে লোক আসবে, তোমাদের গুটি পড়ে গেলেই ময়মনসিংহে নিয়ে যাওয়া হবে। আর ঘটুর মা তো রইলেনই তোমাদের দেখাশোনা করার জন্য।’
“বাবাকে চলে যেতে দেখে মণির গলাটা ধরে আসতে লাগল। মনে হচ্ছিল এবার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসবে, এমন সময় পাশ থেকে কে যেন ঠ্যালা মারল। মণি চমকে তাকিয়ে দেখে ওর থেকে ছোট একটা ছেলে, হাতে দুখানা পাকা আতা। ঘটুর মা চোখ পাকিয়ে বলল, ‘এই যে নবাবাজাদা। এ বাছারা যে কতক্ষণ ধরে দোর ঠকঠাকাচ্ছিল তুই ছিলিস কোথায়?’
“পুনি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কে?’
“ঘটুর মা বলল, ‘ওই দেখো মেয়ের কথা! ওই তো ঘটু গো। তোমাদের জন্য আতা পাড়তে গেছিল।’
“তো ঘটুর সাথে এদের ভারী ভাব হয়ে গেল, অসুখ পুরো কমেনি বলে খুব একটা টোটো করে ঘুরতে পারে না বটে, তবে বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই প্রচুর নেচেকুঁদে বেড়াতে লাগল তিনজনে। ঘটুর মা-ও বড় যত্নআত্তি করতে লাগল, আর তার রান্নার হাতটিও খাসা — সামান্য ঝোলভাতই পুনি-মণিদের কাছে অমৃতের মতন ঠেকতে লাগল।
“দিব্যি চলছিল সব, গোল বাঁধল তেরাত্তিরে। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর পুনি সবে ‘অ্যালিসের অ্যাডভেঞ্চার’ খুলে বসেছে মণি হড়বড় করে ঘরে এসে ঢুকল। মুখটা কী রকম ফ্যাকাশে ফ্যাকাশে লাগছে, চুলগুলোও খাড়া খাড়া ঠেকছে।
“পুনি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছে তোর?’
“মণি এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল, ‘জানিস সিঁড়ি দিয়ে এক্ষুনি একটা বুড়ো লোক একতলায় নেমে গেল, আর কী ভয়ঙ্কর তার চোখ। মনে হল যেন রক্ত বেরোচ্ছে চোখ থেকে।’
“শুনে পুনির গা একটু শিরশির করতে লাগল। চাদরটা ভালো করে টেনে বলল, ‘দুৎ, ভুল দেখেছিস।’
“মণি ভয়ে ভয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে বলল, ‘যদি ডাকাত হয়? চ না ঘটুদের গিয়ে তুলি।’
“‘তোর যেমন কথা, ঘটুরা শুয়ে পড়েছে তো কখন। আর ডাকাত হলে এতক্ষণ চুপচাপ বসে থাকত নাকি? কী দেখতে কী দেখেছিস।’
“দিদির কথায় খুব একটা ভরসা না পেলেও মণি আর কথা বাড়াল না।
“পরের দিন সকালে অবশ্য কী ভেবে পুনি নিজেই কথাটা তুলল ঘটুর মার কাছে। ঘটুর মা তো শুনেই আকাশ থেকে পড়ল, ‘কী বলো দিদিমণি? এ বাড়িতে কস্মিনকালেও চোর-ডাকাত ঢোকেনি।’
“ঘটু শুনে হিহি করে হাসছিল, এবার মার কাছে পেল্লাই ধমক খেল।”

লীলা জল খাওয়ার জন্য একটু থামলেন, এই ফাঁকে শ্যামলকৃষ্ণ চারু দত্তের কানে কানে বললেন, “গল্পটা কখন বুঝলাম জানেন? কুড়ি মিনিট ধরে কড়া নাড়ার পরেও দরজা খুলল না যখন।”
চারু দত্ত একটু ব্যাজার হয়ে বললেন, “বুড়ো লোক মানেই ভূত। আর কদ্দিন যে এ ধারা চলবে?” শ্যামলকৃষ্ণ হাসতে গিয়ে সামলে নিলেন, চারু দত্তের বয়সটা খেয়াল পড়েছে এতক্ষণে।

লীলা ফের শুরু করলেন, “দুরাত পর কিন্তু এবার পুনিই দেখল। দোতলার বারান্দায় রাখা বিশাল দোলনাটায় বসে দুলছিল, এমন সময়ে মনে হল টানা বারান্দার একদম শেষে যে দরজাটা সবসময় বন্ধ থাকে, সেখান থেকে একজন বুড়ো লোক বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল।
“পুনি দেখেই এক ছুটে ঘটুর মার ঘরে গিয়ে হাজির, ‘ঘটুর মা, বারান্দার শেষে যে ঘর সেখানে কে থাকে?’
“ঘটুর মা পুনির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ও মা, ওখানে আবার কে থাকবে? ও ঘর তো কর্তাবাবুরা কবে বন্ধ করে চলে গেছেন। বারান্দার দিক থেকে তো ও দরজা খোলেও না, উলটোদিকের দরজায় গেলে দেখবে কত্ত বড় তালা ঝুলছে।’
“পুনির কথাটা মোটেও বিশ্বাস হল না, আর সেই সঙ্গে খুব রাগও হল। একে তো ঘটুর মা কিছু একটা কথা খুলে বলছে না, তার ওপর ঘটু ফের হিহি করে হাসছে।
“মণি ঘরের মধ্যে ঘুমোচ্ছিল, পুনি ওকে ঠেলে তুলে সব বলল। মণি এমনিতেই একটু বেশি ভিতু, তার ওপর দিদিও একই জিনিস দেখেছে শুনে প্রায় অজ্ঞান হয়-হয়। একটু সামলে নিয়ে কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, ‘চ, সকালে উঠে পালিয়ে যাই।’
“পুনি কট করে একটা গাঁট্টা বসিয়ে দিল ভাইয়ের মাথায়, ‘আর পেনেটি থেকে গড়পার পথ দেখিয়ে কি তুই নিয়ে যাবি?’
“পরের দিন সন্ধ্যা থেকেই মণির গা ছম ছম করতে লাগল, ঘটুর মাকে বলে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে সেই যে ঘরে গিয়ে ঢুকল আর বেরোনোর নামগন্ধ নেই। ঘুমিয়েই পড়েছিল হঠাৎ একটা বিষম ঠ্যালা খেয়ে জেগে দেখে পুনি ঠোঁটের ওপর আঙুল রেখে চুপ করে বাইরে বেরোতে বলছে। দিদির সাহস দেখে মণির তো নাড়ি ছেড়ে যাওয়ার জোগাড়। প্রায় বিষম খেতে খেতে বলল, ‘ওরে বাইরে যাস না। ডাকাত নয়, ভূত। রোজ রাতে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যায়।’
“পুনি ফিসফিস করে বলল, ‘তোর মুন্ডু, ভূত হলে সিঁড়ি দিয়ে নামবে কেন? ভেসে ভেসে চলে যাবে। চল, চল বলছি।’
“বলে প্রায় হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে ওকে টেনে বার করল, করে সেই টানা বারান্দার শুরুর দিকের একটা কোণে ভাই সমেত লুকিয়ে বসে থাকল। মণির মনে হতে লাগল বিশাল বাড়ির মধ্যে অন্ধকার যেন ওকে গিলে খেতে আসছে। এদিকে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে ওরা, আজকে আর কেউ নামে না।
“মণি ফিসফিস করে কাকুতিমিনতি করতে যাচ্ছিল ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য, এমন সময় পুনি নড়ে উঠল। পুনির দিকে চোখ ঘোরাতে গিয়ে মণির চোখের মণি স্থির হয়ে গেল, সেই বুড়ো লোক। আজকে কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে নামছে না, বরং উঠছে। মণি পারলে ওখানেই দিদির হাত ধরে কেঁদে ফেলে, ‘ওরে আজকে যে উঠে আসছে, এদিকেই আসছে বোধ হয়।’
“কিন্তু বলিহারি বটে পুনির সাহস, ধাঁ করে দৌড় লাগিয়েছে বারান্দার উলটো প্রান্তের দিকে। মণি হাঁ করে দেখল পুনি ‘চোর, চোর’ বলে বিকট চেঁচাতে চেঁচাতে গিয়ে সোজা জাপটে ধরেছে ভূতকে।
“কিন্তু তার থেকেও অবাক হল দেখে যে ভূত নিজেই চোখ বন্ধ করে চিৎকার করছে, ‘রাম, রাম, রাম, রাম।’
“পুনি ততক্ষণে চিলচিৎকার জুড়ে দিয়েছে, “ও ঘটু, ও ঘটুর মা, শিগগির এসো। চোর, চোর, চোর…”
“চোর প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ শিউরে উঠে বলল, ‘আ সব্বোনাশ, ও কাদের নাম নিচ্ছেন দিদিমণি?’
“পুনি এবার একটু থমকাল, ‘তুমি চেনো নাকি ঘটুর মাকে?’
“বুড়ো চিঁচিঁ করে বলল, ‘চিনতাম দিদিমণি। প্লেগের পর আর কি চেনার জো আছে?’
“‘কেন রে অলপ্পেয়ে, সাহস থাকলে তাকিয়ে একবার দেখ না চিনতে পারিস কিনা?’ কানের কাছে চেনা আওয়াজটা এসে পৌছতেই সবাই কী রকম মন্ত্রমুগ্ধের মতন তাকিয়ে রইল।
“ঘটুর মা দাঁড়িয়ে, হাতে খুন্তি। মুখ খিঁচিয়ে বলছে, ‘ঘটুর মা না থাকলে গোয়াল সামলাত কে? আর বাড়িঘরের খেয়ালই বা রাখত কে শুনি? এই আফিংখোর বুড়ো নটবর? যে সারাদিন আফিং খেয়ে পড়ে পড়ে ঝিমোয়, আর মাঝরাতে ওঠে বাহ্যির জন্য। তোর হাতের কাছে রুটি-দুধটুকুই বা দিয়ে যায় কে?’
“আর তারপর পুনি-মণির দিকে ঘরে ভারী মোলায়েম গলায় বলল, ‘আর তোমাদেরও বলিহারি যাই বাছা। অত করে বললাম এ বুড়োকে নিয়ে মাথা ঘামিও না, থাকো এখন ওর সঙ্গে আফিং খেয়ে।’
“মণি দিদির হাতে একটা টান দিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। পুনিও চোখ বুঝতেই বুঝতেই দেখে ফেলেছে, ঘটুর মার সেই দশাসই শরীর ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে শূন্যে। চোখ বুজে ফেলেও কি শান্তি? কানে এখনও এসে পৌঁছচ্ছে ঘটুর হিহি হাসি।”

সবাই অল্পবিস্তর বাকরহিত, শুধু সুধীনের মুখে যথারীতি একটু বক্র হাসি। সত্যেন আড়মোড়া ভেঙ্গে বললেন “বেশ ক্লাইম্যাক্সটা এনেছিস কিন্তু। তবে আমি ভাবছিলাম অ্যালান পো-র মতন কিছু শোনাবি, হাড়হিম করা অ্যাডাল্ট ফিকশন, আই মিন সত্যি ঘটনা।”
সুশোভন বললেন, “আপনার স্টকে কিছু নেই সত্যেনদা?”
“কী যে বলিস, খেয়েদেয়ে কাজ নেই নাকি আমার?” বলতে বলতে দরজার দিকে তাকিয়ে সত্যেন চেঁচিয়ে উঠলেন, “আরে জ্যোতির্ময়, এসে গেছ দেখছি! দাঁড়াও আসছি।”
চারু দত্তের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, “চারুবাবু, আজকের কাগজটায় একদম চোখ বোলাতে পারিনি, একটু দিন না, ওটা নিয়ে যাই। আমার কলিগ জ্যোতির্ময় গুপ্ত বাইরে এসে দাঁড়িয়ে আছেন, আজ ওনার সঙ্গেই বাড়ি ফিরব।”
চারু দত্ত কাগজটা বাড়াতে গিয়ে নিঃস্পন্দ হয়ে গেলেন, খোলা পাতার নিচের দিকে দেখা যাচ্ছে পথ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন পদার্থবিদ্যার এক অধ্যাপক, কলকাতা পুলিশ জানাচ্ছে তাঁর নাম জ্যোতির্ময় গুপ্ত।

 

ছবি – সুমিত রায়


প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পরিচয়ের আড্ডায়’ বইটি সম্পর্কে আলাদা করে কিছু বলার থেকে আমরা বরং বইটির ভূমিকা হিসাবে লেখক যা লিখেছেন, সেটা পড়ে নিই। বইটি থেকে বেছে নেওয়া ওপরের গল্পটি এবং নিচে দেওয়া বইটি সম্পর্কে লেখকের মুখবন্ধটি পড়ে বইটা সম্পর্কে কেউ আগ্রহী হলে, সৃষ্টিসুখ-এর সাইট থেকে বইটি অর্ডার করতে পারেন


পরিচয়ের আড্ডা প্রসঙ্গে

সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পরিচয় পত্রিকার সম্পাদনার ভার নেন ১৯৩১ সালে। প্রথমে ঠিক হয়েছিল দেশ বিদেশের নানা বইয়ের সঙ্গে বাঙালি পাঠকদের আলাপ করিয়ে দেওয়াই হবে এ পত্রিকার উদ্দেশ্য, তাই নাম রাখা হয়েছিল ‘পরিচয়’। সুধীন্দ্রনাথ নিজে এবং তাঁর বাঘা বাঘা পণ্ডিতবন্ধুরা গ্রন্থ সমালোচনা বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। সুধীন আলোচনা করছেন বিখ্যাত অস্ট্রিয়ান ঔপন্যাসিক হারম্যান ব্রকের ঊনবিংশ শতকের ‘লিটারারী রিয়ালিজম’ নিয়ে লেখা প্যারডি ‘দ্য স্লীপওয়াকারস’ নিয়ে, তো চারুচন্দ্র দত্ত কলম ধরছেন সপ্তদশ শতকের ফরাসি কূটনীতিবিদ ট্যালেরঁ-র জীবনীগ্রন্থ নিয়ে। বিষ্ণু দে সুচিন্তিত মতামত রাখছেন ভার্জিনিয়া উলফের নতুন বই নিয়ে আর ধূর্জটিপ্রসাদ জানাচ্ছেন জন স্ট্রেচির সমজাতত্ত্বের বইগুলি ভারতবাসীর এখনই পড়ে ফেলা কেন দরকার। পশ্চিমী সাহিত্যিকদের রমরমা থাকলেও গ্রন্থ-পরিচয় বিভাগে শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথদেরও দেখা মিলত মাঝে মাঝেই।

শুরুর কয়েক বছরের মধ্যেই কিন্তু ‘পরিচয়’ দেখা দিল এক উঁচুদরের প্রবন্ধসাহিত্যের পত্রিকা হিসাবে। তারপর যত দিন গেছে পরিচয়ের সম্পাদকমন্ডলী স্থান দিয়েছেন কবি, ঔপন্যাসিক এমনকী নাট্যকারদেরও। সুধীন্দ্রনাথের পর এ পত্রিকার দায়িত্ব সামলেছেন গোপাল হালদার, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, তরুণ সান্যাল বা দেবেশে রায়ের মতন প্রথিতযশা সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা, শুরুর বছর পঞ্চাশ পরেও পরিচয় চেষ্টা করে গেছে বাঙালি পাঠককে ‘ফুড ফর থট’ জুগিয়ে যেতে। কিন্তু এ বইয়ের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ফিরে দেখব শুধুমাত্র তিরিশের সেই দশকটাই, যখন সুধীন্দ্রনাথের বাড়িতে প্রতি শুক্রবার জমা হচ্ছেন পঁচিশ-তিরিশ জন মানুষ, পত্রিকার গুণাগত মান কীভাবে বাড়ানো যায়, সে আলোচনার বাইরে গিয়েও জমে উঠছে এক অনন্যসাধারণ আড্ডা।

বৈদগ্ধের ভারে মাঝেসাঝে এ আড্ডার আলোচনাসমূহ তরুণ সাহিত্যানুরাগীদের জন্য গুরুপাচ্য হয়ে উঠত। শ্যামলকৃষ্ণ ঘোষ তাঁর ‘নাইরোবি থেকে রবি’ (লালমাটি, ২০১৪) বইয়ে জানাচ্ছেন, “পরিচয়ের আসরে প্রবোধ বাগচী, সুধীন্দ্রনাথ, শাহেদ সুরাওয়ার্দি ইত্যাদি ফরাসি সাহিত্যবিদরা যখন আঁরি ফোকে নিয়ে, আঁদ্রে মালরো, মোরিস বেদেল, আঁদ্রে জীদ ও রেনেগ্রুসের সদ্য রচিত গ্রন্থ সম্বন্ধে আলোচনা করতেন তখন আমার মতো অনেককে নীরব থাকতে হত।” একই বইয়ে সাহিত্যিক ও গায়ক জীবনময় রায়ের প্রসঙ্গে শ্যামলকৃষ্ণ জানিয়েছিলেন, “আমার মনে হয় যে ইংরেজি ভাষায় কথা বলায় অভ্যস্ত না থাকায় তিনি আসরে অবাঙালি ও বাঙালি সাহবদের উপস্থিতিতে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন এবং সেইজন্যেই শেষ পর্যন্ত যাওয়া কমিয়ে দেন।” কিন্তু এসব সামান্যই ত্রুটিবিচ্যুতি। আর চার-পাঁচটা বাঙালি আড্ডার মতনই এখানেও সদস্যরা বিষয়ের বৈচিত্র্য ভালোবাসতেন। তাই চারুচন্দ্র দত্তের অলৌকিক গল্পের আসরগুলো জমজমাট থাকত। একইভাবে হুমায়ুন কবীর বা হিরণ সান্যাল বা ধূর্জটি মুখোপাধ্যায়রা যখন দেশবিদেশের ভোজনসামগ্রী নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠতেন, সোৎসাহে সেই আলোচনায় অংশ নিতেন পরিচয়ের বাকি সদস্যরাও।

শ্যামলকৃষ্ণ ঘোষ তাঁর ডায়েরির পাতায় পরিচয়ের আড্ডার বিষয়সমূহ নিয়ে লিখে রাখতেন, তাঁর মৃত্যুর পর সেসব লেখা বই হয়ে বেরোয়। আমার সে বই পড়ার সৌভাগ্য হয়ে ওঠেনি। ‘নাইরোবি থেকে রবি’-র পাতায় কিছু টুকরো-টাকরা উদাহরণ পাওয়া যায় বটে, কিন্তু তাতে বৈঠকি মেজাজটা ধরা পড়ে না, একটা পুরোদস্তুর আড্ডা সেশনে ঠিক কীভাবে আলোচনা গড়ে উঠত বা গল্পের প্রেক্ষাপট তৈরি হত, সেটাও বোঝা যায় না। এটা অবশ্য কোনও অভিযোগ নয়, নেহাতই পর্যবেক্ষণ। স্বভাবতই নিজের ব্লগে যখন পরিচয়ের সদস্যদের নিয়ে গল্প লিখতে বসলাম, মূল ভরসা ছিল ওই কল্পনাশক্তিই। তাই ‘পরিচয়ের আড্ডায়’ সম্পূর্ণভাবেই ফিকশন। যদিও এ বইয়ের পটভূমিকা এবং চরিত্রগুলি ঐতিহাসিক ভাবে সত্য। গল্পগুলির মধ্যে দিয়ে আমি পরিচয়ের আড্ডার চরিত্রটিকে ধরার চেষ্টা করেছি, তুলে আনতে চেয়েছি একটা সাবেক বৈঠকি মেজাজ। কিন্তু একইসঙ্গে দেখানোর চেষ্টা করেছি বহু গল্পের সূত্রপাতই ইতিহাসের পাতায়। সে ইতিহাস অবশ্য পাঠ্যপুস্তক থেকে মিলবে না, তার জন্য দরকার একটু বিশেষ ধরনের অনুসন্ধিৎসা। পরিচয়ের আড্ডায় সেরকম অনুসন্ধিৎসু আড্ডাবাজ বেশ কিছু ছিলেন, তাই কল্পনা এবং বাস্তবের মেলবন্ধন ঘটাতে আমাকে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি।

এ বইয়ের আড্ডার গল্পগুলিতে অবশ্য গুটিকতক মানুষই ঘুরেফিরে এসেছেন, তার একটা মুখ্য কারণ হল পরিচয়ের আড্ডার ইতিহাস জানায় মুখ্যত এঁরাই ছিলেই বক্তা, আসর সরগরম করে রাখতে এঁদের জুড়ি মেলা ছিল ভার। আমার আড্ডায় আবার এঁদের মধ্যমণি সত্যেন্দ্রনাথ বোস। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, বাঙালি পাঠকের সঙ্গে সত্যেন বোসের নতুন করে আলাপ করিয়ে দেওয়াটা একপ্রকার ধৃষ্টতা। কিন্তু এই সব আড্ডায় সত্যেন কদাচিৎ তাঁর বৈজ্ঞানিক অবতারে আবির্ভূত হতেন। এই আড্ডাবাজ সত্যেনকে কজন বাঙালি চেনেন সেটা নিয়ে অবশ্য একটা সন্দেহের অবকাশ থেকে যায় । সত্যেন বোসের জন্মশতবার্ষিকীতে দেশ পত্রিকায় তাঁকে নিয়ে লিখতে গিয়ে জয়ন্ত বসু জানিয়েছিলেন পরিচয়েরও আগে নিজের সাহিত্যপ্রীতির জন্যই সত্যেন প্রমথ চৌধুরীর সবুজপত্রের আসরে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন। ঢাকার থাকার সময়ে নিজের উদ্যোগেই বসিয়েছিলেন এক ঘরোয়া আসর, যার নাম ছিল ‘বারো-জনা’। এমনকী শেষ বয়সে তাঁর ঈশ্বর মিত্র লেনের বাড়িতে প্রতি শনিবার বসত সান্ধ্য বৈঠক। বিজ্ঞানের প্রায় প্রতিটি শাখাতে তো বটেই, সাহিত্য, শিল্পকলা, রাজনীতি, সমাজতত্ত্বেও সত্যেন বোসের ছিল অবাধ বিচরণ। শ্যামলকৃষ্ণের লেখা পড়ে আমরা এও জানতে পারি যে, সত্যেন বোস অতিপ্রাকৃত গল্প শুনতে ভালোবাসতেন। নিছক ভূতের গল্প বলতে রীতিমতন উৎসাহ দিতেন পরিচয়ের আড্ডার সদস্যদের।

‘বন্ধ ঘরের রহস্য’ বা ‘পেনেটির সেই রাত’ লেখা হয়েছে মূলত সত্যেন এবং অন্য আড্ডাবাজদের ভূত এবং রহস্য গল্পপ্রীতির কথা মাথায় রেখে। ‘পেনেটির সেই রাত’-এর পেছনে অবশ্য আরেক অনুপ্রেরণা আছেন — লীলা মজুমদার। পরিচয়ের আড্ডায় যে কজন তরুণ, উদীয়মান লেখক আসতেন লীলা ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তখন অবশ্য তিনি লীলা রায়, পরিচয়ের পাতায় মূলত ইংরেজি সাহিত্যগ্রন্থের সমালোচনা করতেন। কিন্তু কে বলতে পারে সেই আড্ডার মাঝে বসেই লীলা তাঁর অনবদ্য ভূতের গল্পের প্লটগুলির ভেবে ফেলতেন না? কিছু কিছু গল্পের স্থান নিয়ে ভাবার দরকারই পড়েনি। ঐতিহাসিক কারণেই সে সব গল্পের প্লট অন্য কোথাও গড়ে উঠতে পারত না। সত্যেনের বাল্যবন্ধু ধূর্জটিপ্রসাদ (কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বাবা) লখনৌ বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা যায় নিজের হাতে গড়ে তুলেছিলেন, তিনি পরিচয়ের আড্ডার অন্যতম বিশিষ্ট সদস্যও। সুতরাং, ‘কিসসা লখনৌ কা’ আর কোথায়ই বা হতে পারত? শ্যামলকৃষ্ণ ঘোষও তখন বয়সে তরুণ, সদ্য পূর্ব আফ্রিকায় কৈশোর কাটিয়ে এসেছেন। শ্যামলকৃষ্ণ গল্প বললে কেনিয়া, উগান্ডা কী তানজানিয়া পটভূমি হয়ে ওঠার যথেষ্ট সম্ভাবনা, আর তাই জন্যই ‘নামসাগালিতে’ গল্পটা কে বলবেন সে নিয়ে আমাকে দুবার ভাবতে হয়নি। একইভাবে সত্যেন্দ্রনাথের কর্মস্থল ঢাকা ছিল বলেই ‘কেচ্ছা-কাহিনি’ অন্য কোথাও হতে পারত না। এ গল্প প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখা ভালো যে, শঙ্খনিধি লালমোহন সাহার ‘সর্ব্বদদ্রুহতাশন’ এবং ‘কন্ডুদাবানল’ ওষুধ দুটি কিন্তু সত্যিই ছিল — ডিবা প্রতি ছ আনা দাম এবং বিকোতও হটকেকের মতন।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয়ের অধিকাংশ সদস্যের ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল এবং প্রায় প্রত্যেকেই অপরিসীম শ্রদ্ধা করতেন তাঁকে। তাই রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গ বারে বারেই এসেছে, তবে যে গল্পটি রবীন্দ্রনাথকে না টেনে এনে লেখাই যেত না, সেটি হল ‘শব্দসন্ধানী’। ‘শেষের কবিতা’-র অমিত রায়ের চরিত্রটি কার আদলে তৈরি, তা নিয়ে কিছু কথা বলেছিলেন শ্রদ্ধেয় অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত তাঁর আত্মজীবনী ‘আট দশক’-এ। সেখান থেকেই জানতে পারি ইংরেজির অধ্যাপক অপূর্ব চন্দ (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য আরেক সদস্য চারুচন্দ্র দত্ত এঁর শ্বশুর হতেন) এবং ইতিহাসের অধ্যাপক সুশোভন সরকার দুজনেই মনে ধরেছিল রবীন্দ্রনাথের। বলা বাহুল্য যে, ইতিহাসাশ্রিত গল্পগুলিতে (‘জুলিয়াস সিজারের ক্যালেন্ডার’ বা ‘গণেশপুরাণ’) সুশোভনের একটি বিশেষ ভূমিকা আছে। তিনি হয়তো কথক নন, কিন্তু ইতিহাসের খেইগুলো ধরিয়ে দেওয়ার জন্য তাঁকে আমাদের বিশেষভাবে দরকার। সুশোভন-সুধীন-সত্যেনদের জন্যই পরিচয়ের আড্ডা মাঝে মাঝেই জমে উঠত শিল্প সমালোচনা ঘিরে। কবি বিষ্ণু দে-র সঙ্গে এই আড্ডায় মাঝে মাঝে দেখা মিলত শিল্পী যামিনী রায়ের। তাঁরা এলে তো আরও পোয়া বারো, স্থায়ী এবং অস্থায়ী সদস্যরা মিলে মশগুল হয়ে যেতেন আধুনিক ও ধ্রুপদী শিল্পকলা নিয়ে নানা গল্পগুজবে। ‘কালো শুধু কালো নয়’ লেখা হয়েছে পরিচয়ের আড্ডার সেই ট্র্যাডিশনটি মাথায় রেখে।

প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা ভালো যে, বেশ কিছু গল্পেই শুরুর বিষয়টি থেকে আড্ডাবাজরা সরে এসেছেন, গল্প শেষ হয়েছে সম্পূর্ণ অন্য একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে — সবই আড্ডার খাতিরে। সত্যিকারের আড্ডা চিরবহমান এবং বিশেষত বাঙালির আড্ডা কদাচিৎ এক বিষয়ে ঘুরপাক খেতে থাকে। আড্ডাই যেহেতু এ বইয়ের প্রাণ, তাই সেই ধাঁচটিকে গল্পের মধ্যেও রেখে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আড্ডা কখনও কখনও ঘুরপাক খেত সদস্যদের ব্যক্তিজীবন ঘিরেও। ‘কবির বিভ্রম’ গল্পটি লেখা হয়েছে সেরকমই একটি ঘটনা মাথায় রেখে — শোনা যায় সুধীন্দ্রনাথের বিখ্যাত কবিতা ‘শাশ্বতী’র পেছনে রয়ে গেছে এক বাস্তব অনুপ্রেরণা। ইউরোপ ভ্রমণের সময় সুধীন্দ্রনাথের সামনে সত্যিই কি কেউ এসেছিলেন ‘অনাদি যুগের যত চাওয়া, যত পাওয়া’র কথা স্মরণ করিয়ে দিতে?

বন্ধুবর এবং প্রকাশক রোহণ কুদ্দুসের উৎসাহ না পেলে এ বই লেখা সম্ভব হয়ে উঠত না। বন্ধু বলেই রোহণকে ধন্যবাদ জানাতে চাই না। কিন্তু রোহণকে সঙ্গে নিয়ে ধন্যবাদ জানাতে চাই দুই অতুলনীয় শিল্পী দেবাশীষ দেব এবং সুমিত রায়কে। দেবাশীষদা-র প্রচ্ছদ এবং সুমিতবাবুর অলঙ্করণ ছাড়া এই বই ‘বই’ হয়ে উঠতে পারত না। ধন্যবাদ জানাই সন্মার্গ মিত্র, কৌশিক দত্ত, শকুন্তলা ভাদুড়ী, স্বাতী সেনগুপ্ত, চৈতালী সেন, সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়, সায়ন মুখার্জী এবং ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’ ব্লগের একাধিক পাঠককে, যাঁদের ছাড়া পরিচয়ের আড্ডা কোনও মতেই জমে উঠতে না। এ আসর বসানোর বন্দোবস্ত অবশ্য একজনই করতে পারতেন, কিন্তু চিত্রালীকে ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা কোনওটা জানানোর স্পর্ধাই আমার নেই!

প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থাকেন ইস্তানবুলে, পেশায় অধ্যাপক এবং নেশায় ব্লগার। ওঁর বাংলা ব্লগপোস্টগুলি পড়া যাবে 'সাড়ে বত্রিশ ভাজা' ব্লগে। সৃষ্টিসুখ প্রকাশন থেকে প্রবীরেন্দ্রর চারটি বই প্রকাশিত হয়েছে - 'Byte বিলাস', 'ক্যুইজ্ঝটিকা', 'পরিচয়ের আড্ডায়' এবং 'ফের ফেলুদা, আবার ব্যোমকেশ' (ফেলুদা - ব্যোমকেশ প্যাস্টিশ)।