A+ A-

‘People who are creative don’t die’

জুন ২২, ১৮৯৭ — প্রকাশচন্দ্র দেব রায়সাহেব উপাধিতে ভূষিত হলেন। রেসিডেন্স – শিলং, অসম। তখন শিলং অসমের অন্তর্গত ছিল। ই হ্যারিসন ১৮৯১-তে রিটায়ার করার পরে প্রকাশচন্দ্র অসম সেক্রেটারিয়েট (সিভিল)-এর প্রথম বাঙালি সুপারিটেন্ডেন্ট নিযুক্ত হন। ১৮৬৪-১৯১৫ অব্দি শিলংয়ের মূল উপনিবেশ ছিল নন-ট্রাইবালদের, মূলত বাঙালিদের। শিলং প্রকৃতপক্ষেই ব্রিটিশদের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাজের একটা সুন্দর, petite অঞ্চল। মিউনিসিপাল বোর্ড যখন গঠন হল, অর্থাৎ ১৮৭৮-এ, তখন শিলংয়ের জনবসতি ২,১৪৯; ১৮৮১-তে দ্বিগুণ প্রায় ৪,২৮৮; ১৯০১-এ তা বেড়ে ৯,৬২১; ১৯১১-এ ১৩,৬৩৯। কিন্তু শিলংয়ের এই বেড়ে ওঠা খামখেয়ালিভাবেই, বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্ন, উদাসীন। ১৮৭২-এর সেন্সাস রিপোর্টে শিলংকে একটি মিলিটারি স্টেশন হিসেবেই উল্লেখ করা আছে মাত্র, ডিস্ট্রিক্ট হেডকোয়ার্টার বড়োজোর, একটা বাজার — এটুকুই। ১৯০১-এর এপ্রিল মাসে স্বামী বিবেকানন্দ শিলংয়ে এসেছিলেন কুইন্টন হলের উদ্বোধনে ভাষণ দিতে। ১৯৪৭-এর পর প্রায় ২৫ বছর শিলং অসমের রাজধানী ছিল। প্রকাশচন্দ্রের কন্যা কুঞ্জলতা জন্মগ্রহণ করেন ১৮৭৩-এ শিলংয়ে। ১৮৮৮ সালে কুঞ্জলতার বিয়ে হয় গিরিশচন্দ্র নাগের সঙ্গে। গিরিশচন্দ্র বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে শিলংয়ে ৪টি বাড়ি বানান। তার একটি উত্তরাধিকারসূত্রে পান সুশীলচন্দ্র নাগ — পারিবারিক প্রয়োজনে সুশীলচন্দ্র বাড়িটি বেশিদিন রাখতে পারেননি, বিক্রি করে দিতে হয়েছিল Sunny Lodge। তার প্রায় লাগোয়া Shanta Lodgeটি ছিল সুশীলচন্দ্রের ছোট ভাই প্রভাতচন্দ্রের। আমার কোনওদিনও ঠাকুরদার বাসায় যাওয়া হয়নি। আমার তুতো ভাইরা পরে শিলংয়ের Jail Road-এ Sunny বা Shanta কোনও লজেরই কোনও চিহ্ন দেখতে পায়নি। ২০১৪ সালে আমি একবার শিলং যেতে চেয়েছিলাম, measle হওয়াতে ক্যানসেল করতে হয়েছিল। আমি আর কখনও শিলং, আমার ঠাকুরদার বাসা, শিলংয়ের পাহাড়, আকাশ, বাতাস, রঙিন প্রজাপতি দেখতে চাইব না।
ফেব্রুয়ারি ৬, ২০১৫ — খুব মজা হয় না, বইমেলায়? কবে যে দেখব। কলকাতায় আসার কথা ছিল এই ২৪শে জানুয়ারি, কিন্তু হল না। কেন হল না, সেটা পরে কখনও বলব।
জুন ১৫, ২০১৩ — কেমন আছো? জ্বর কমল? তোমার লেখা পড়তে পড়তে অঝোরে কাঁদলাম। আজ ছ’মাস অ্যাক্সিডেন্টের পরও মনে হয় মা কবে বলবেন, মেয়েটা কি আবার হাঁটতে পারবে? এই অযথা চিন্তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা মমতা অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াই রোজ, মা ছেড়ে থাকা বড্ডো কষ্ট, বোঝানো যায় না।
এপ্রিল ১৬, ২০১৩ — আমি গত ৩ মাস থেকে ইমমোবাইল ছিলাম জানতে না, অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল আমেদাবাদে, FB-তে পোস্ট ছিল তো, দেখোইনি। রাস্তা ক্রস করার সময় বাইক হিট করেছিল।
আগস্ট ১, ২০১২ — ভিসা করতে তোমাদের কলকাতা এসেছিলাম।
জুলাই ৩১, ২০১২ — কাল হঠাৎ পুরনো মেইলবক্সে গিয়ে দেখলাম কত কত মেইল আমরা শেয়ার করেছিলাম — ভালো লাগল আবার।
জুন ২, ২০১২ — তুমি শুনলাম হাসো? এটা কি সত্যি? আমার মনে হয় তুমি খুব গম্ভীর মুখে লেখো, একটাও কথা বলো না, কখনও হাসো না, কেমন যেন দেখলেই ভয় লাগবে। একমাত্র লাট্টুর সঙ্গে মাঝে মাঝে একটু খুশি মুখ দেখা যায়।
 মে ২৩, ২০১২ — এখানে সুন্দর নির্মল বাতাস মিষ্টি রোদ্দুর আর মাঝে মাঝে বৃষ্টি অপেক্ষা করছে তোমার মতো লোকের উপভোগ করতে আসার ।
মার্চ ২৮, ২০১২ — আমার চেম্বারটা ছোট, পাশে আরও ছোট আমার পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট-এর ঘর, সামনে করিডোর — জানলা দিয়ে সবুজ জঙ্গল, একটু বেন্ড করলে অস্ত যাওয়া সূর্য আর লেকের জলে তার প্রতিচ্ছবি। আজকাল বিকেলে রোদ দেখলে মায়ের কথা মনে পড়ে, ছবি তোলার মন যায় না। জানো, সবার বাড়ি যাওয়ার তাড়া আছে, আমার নেই। সেই যে মায়ের অপেক্ষা, অসহ্য যন্ত্রণা… bye I don’t want to talk
মার্চ ৯, ২০১২ — You know today I felt may be I won’t like to meet you ever… you are a writer who shares his stories personally. I kind of get hints of your imagination, your plot yet I know nothing — there’s a mystery in it.
নভেম্বর ৮, ২০১১ — Cherry blossoms all around, trees with autumn colours and the blue sky.
অক্টোবর ১২, ২০১১ — উফফফফ, ক্যাটারপিলার এত জঘন্য একটা প্রাণীকে নিয়ে কবিতা — ধন্য তুমি। এখানে অনেক পাওয়া যায়, রং-বেরঙের, তোমায় একবাক্স পাঠিয়ে দিলে ভালো হবে। পড়াশোনা করব বলে নেট খুলে এসব প্রাণী — হা হা । যাকগে, ফোন, নেট এই নাহলে আমার কীভাবে বাঁচতাম? তোমরা সবাই মিলে জীবনটা অনেক কালারফুল করে দাও জানো। পুরো শরতের আকাশ — নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, রং-বেরঙের ফুল, মিষ্টি ঠান্ডা। ভারী ভালো। আমরা লেপ গায়ে দিচ্ছি আর দিনে সোয়েটার — autumn is very nice, একবার এসো, এখানে এখন ফেস্টিভ্যালও হয় নানা।
অক্টোবর ৪, ২০১১ — বাড়িটা একদম খালি লাগে। এখনও যেতে ইচ্ছে করছে না। প্যান্ডেলগুলোতে যাওয়ার কথা ভাবলেই মায়ের হাতটা মনে পড়ে, তাই পালিয়ে বেড়াই, সেটাই বেস্ট। My Mom’s loss is just too big for me… আজ একটা ভোগ দিয়েছি বাড়িতে — keeping with mass tradition — আমার লাইফে ফার্স্ট টাইম মা-বাবা ছাড়া পুজো ।
আগস্ট ৭, ২০১১ — People who are creative don’t die
জুলাই ২১, ২০১১ — মানুষ চলে যায়, তার ছবিটা থেকে যায় মনের মধ্যে, কাগজের মধ্যে। ভাবো, আজ যদি মায়ের ছবি না থাকত? আমি তো ঘরে ঘরে মাকে বসিয়ে রেখেছি যাতে আসতে যেতে মায়ের সঙ্গে কথা বলি, আমার সব কথা। ছবি একটা দারুণ জিনিস — জীবনের কত জিনিসকে ধরে রাখতে সাহায্য করে, কত ভুলে যাওয়া মুহূর্তকে সজীব করে তোলে, তাই না?
মার্চ ১৮, ২০১১ — কিছু ভালো লাগে না, সব আছে — পড়াশোনা, কমফোর্ট, ব্যস্ততা, তবু সবই ফাঁকা, কোথাও যেন সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। গতবার চৈত্রমাসে মায়ের সাথে বাসন্তী পুজোয় গিয়েছিলাম — আজ সব খালি। মা আর নেই-টা মানতে পারছি না জানো, থেকে থেকেই মনে হয় এটা মাকে বলতে হবে, ওটা বলতে হবে। তুমি কবিতা পাঠালে মাকে বলতাম। কিছু ভালো লাগে না, একদম না, বাঁচার লড়াই রোজ। সবাই তাই করে জানি, তবু কারও জন্য করা একটা প্রেরণা, শুধু নিজের জন্য বাঁচা তো স্বার্থপরতা, তাই না?
সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১০ — My mother is critically ill fighting for life with paralysis of intestine. Please, my friend, pray for her.
জানুয়ারি ১২, ২০১৬ — আঁকাবাঁকা সরু রাস্তা, ডান দিকে জঙ্গলে ঢাকা খাদ। এ রাস্তার শেষ লক্ষ্য অমিতের বাসা। সেখানে যাত্রী-সম্ভাবনা নেই, তাই সে আওয়াজ না করে অসতর্কভাবে গাড়ি হাঁকিয়ে চলেছে। ঠিক সেই সময়টা ভাবছিল, আধুনিক কালে দূরবর্তিনী প্রেয়সীর জন্যে মোটর-দূতটাই প্রশস্ত – তার মধ্যে “ধূমজ্যোতিঃসলিলমরুতাং সন্নিপাতঃ” বেশ ঠিক পরিমাণেই আছে – আর, চালকের হাতে একখানি চিঠি দিলে কিছুই অস্পষ্ট থাকে না। ও ঠিক করে নিলে আগামী বৎসরে আষাঢ়ের প্রথম দিনেই মেঘদূতবর্ণিত রাস্তা দিয়েই মোটরে করে যাত্রা করবে, হয়তো বা অদৃষ্ট ওর পথ চেয়ে “দেহলীদত্তপুষ্পা” যে পথিকবধূকে এতকাল বসিয়ে রেখেছে সেই অবন্তিকা হোক বা মালবিকাই হোক, বা হিমালয়ের কোনো দেবদারুবনচারিণীই হোক, ওকে হয়তো কোনো-একটা অভাবনীয় উপলক্ষে দেখা দিতেও পারে। এমন সময়ে হঠাৎ একটা বাঁকের মুখে এসেই দেখলে আর-একটা গাড়ি উপরে উঠে আসছে। পাশ কাটাবার জায়গা নেই। ব্রেক কষতে কষতে গিয়ে পড়ল তার উপরে – পরস্পর আঘাত লাগল, কিন্তু অপঘাত ঘটল না। অন্য গাড়িটা খানিকটা গড়িয়ে পাহাড়ের গায়ে আটকে থেমে গেল।
একটি মেয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। সদ্য-মৃত্যু-আশঙ্কার কালো পটখানা তার পিছনে, তারই উপরে সে যেন ফুটে উঠল একটি বিদ্যুৎরেখায় আঁকা সুস্পষ্ট ছবি – চারি দিকের সমস্ত হতে স্বতন্ত্র। মন্দরপর্বতের নাড়া খাওযা, ফেনিয়ে-ওঠা সমুদ্র থেকে এইমাত্র উঠে এলেন লক্ষ্মী, সমস্ত আন্দোলনের উপরে – মহাসাগরের বুক তখনো ফুলে ফুলে কেঁপে উঠছে। দুর্লভ অবসরে অমিত তাকে দেখলে। ড্রয়িংরুমে এ মেয়ে অন্য পাঁচজনের মাঝখানে পরিপূর্ণ আত্মস্বরূপে দেখা দিত না। পৃথিবীতে হয়তো দেখবার যোগ্য লোক পাওয়া যায়, তাকে দেখবার যোগ্য জায়গাটি পাওয়া যায় না।
নভেম্বর ২৮, ২০১৬ — শিলাদা ফেসবুকে নেই, হোয়াটসাপেও না । শিলাদা কোনও এক প্রাচীনকালে শিলং গিয়েছিল । সেই তার লাবণ্যের সঙ্গে দেখা। ১১ মাস পর কমুনিকেশনের যুগে শিলাদার মতো এক প্রিমিটিভ মানুষ আমায় জানাল সব শেষের কবিতা কাব্যিক হয় না। সব কবিতার শেষ ও হয় না, হয়তো।
অমিতাভ নাগ

অমিতাভ নাগ চলচ্চিত্র বিষয়ক প্রবন্ধ, চলচ্চিত্র সমালোচনা এবং পরীক্ষামূলক আঙ্গিকে গল্প লিখে থাকেন। Silhouette নামক চলচ্চিত্র বিষয়ক ম্যাগাজিনের সম্পাদক অমিতাভর উল্লেখযোগ্য বই — Beyond Apu - 20 Favourite Film Roles of Soumitra Chatterjee (HarperCollins India), আত্মঅবমাননা বিষয়ক এক-দুই কথা (সৃষ্টিসুখ প্রকাশন) ইত্যাদি।

Read Next: আমার ঝাড়গ্রাম (শেষ পর্ব)

Join the Discussion

Your email address will not be published. Required fields are marked *