সঙ্গীতা দাশগুপ্তরায় ওরফে সই ওরফে ‘তেকেনা’র লেখার সাথে পরিচয় আমার তা হল প্রায় আট-দশ বছর। বাংলালাইভে প্রকাশিত ‘পরিকথা’ গল্পের লিংক যে দিয়েছিল সে লেখক সম্পর্কেও কিছু তথ্য দেয়, কিছুটা অনাবশ্যকভাবেই। নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় সেসব কথায় আমার কৌতূহল জাগে। তাহলে কি এই লেখক এমন কিছু লিখেছেন, যা হজম করতে পেটরোগা বাঙালির একটু অসুবিধে হচ্ছে!? খানিক সেই কৌতূহল থেকেই গল্পটা পড়তে শুরু করি। তা শুরুর দিকে গল্প খুব না টানলেও ডিটেলের কাজ বেশ লাগে এবং গল্পের শেষের দিকে এসে বুঝতে পারি এ গল্প নিছকই গোলগাল টিপিকাল একটি প্রেম-অপ্রেমের গল্প নয়। গল্পের রুচিরা একেবারে রক্তমাংসের আস্ত এক মানুষ হয়ে তার তীব্র প্রশ্নটি নিয়ে হাজির হয় সামনে। মনে মনে নোট করি এই লেখকের লেখাকে একটু নজরে রাখতে হবে।
তা সেই পরিকথা সহ এক ডজন গল্প নিয়ে সঙ্গীতার এই বই ‘সুয়োকথা দুয়োকথা’। গল্পগুলো উঠে এসেছে সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে, কঙ্কনা অত্রিদের আমরা চিনি খুব। তাদের সুখ-অসুখও খুব অচেনা নয়। বাসু বা যোগেশচাচাকে কি চিনি ততটা? রাস্তার পাশের মেহেন্দিওয়ালার দিনযাপন টেনে রাখে ‘মন, জলছবি’র সবকটি পৃষ্ঠাজুড়ে। ‘বিষকন্যা’র তীব্র প্রতিশোধ চোখ ধাঁধিয়ে দিলেও এই গল্পটি কেমন যেন দ্রুত শেষ হল, ঠিক গড়ে উঠতে পারল না। ‘সমাজতান্ত্রিক’ পড়েছিলাম আনন্দবাজার রবিবাসরীয়তে। তখনও যেমন এখনও তেমন, বেশ পছন্দের গল্প। সংবাদমাধ্যম দ্বারা মানুষকে, মানুষের অস্তিত্ব, বেঁচে থাকাকে কিছু ‘টিজার’ কিংবা ‘বাইট’ বানিয়ে দেবার নির্লজ্জ প্রচেষ্টা বড় নিখুঁতভাবে এসেছে। ‘পিকাইয়ের জানলা’ আর একটা পছন্দের গল্প। ‘পছন্দের’ শব্দটা লিখতে গিয়ে হাতটা আসলে একটু কেঁপে গেল। এ গল্পকে হরর স্টোরি বলেও চালানো যায়। সতর্ক না হলে আমাদের সামনে হয়তো এমন শত শত পিকাই তাকিয়ে থাকবে শূন্য চোখে। শিকড়ছেঁড়া গাছের মতো যে জীবনটি আমরা যাপন করে চলেছি পরম আহ্লাদে, তা শুষে নিচ্ছে প্রাণের সবটুকু রস, সেই সত্যই দেখায় সই নরম তুলির আঁচড়ে। ‘নীলকণ্ঠর বন্ধুরা’ চেনা লোভ আর ঈর্ষার ছবি দেখায়, একটানে পড়ে ফেলা যায়। কখনও জয় করবার ইচ্ছে এসে ধরছে লোভের হাতটা, কখনও বা নরম এক ভালোলাগা অতিক্রম করে যেতে চাইছে লোভকে। ‘চন্দ্রলেখার প্রেম’ মানে ব্যাঙকুমারীর গল্পটা এই সংকলনে সবচেয়ে দুর্বল গল্প। আসলে ব্যাঙকুমারীর গল্পের বদলে বিভাসের গল্পটা সংকলনে এলেও পারত। 😉 ‘বাতাসঘরে আকাশকুসুম’ সেই বাংলা চ্যাটের আদিযুগের ছবি। ‘গোল্ড এজ হোম’ মিষ্টি ইচ্ছাপুরণের গল্প, সুখপাঠ্য। ‘নারীজমিন’ গল্পটি শুরুতে এক ভয়ংকর সত্যের দিকে এক ঝলক আলো ফেলে যায়। আমরা জানি ভারতে বেশ বড় সংখ্যক শিশু মোলেস্টেশানের শিকার হয় আর এর বেশিরভাগই হয় বাড়িতে অথবা আত্মীয়গৃহে, ঘনিষ্ঠ আত্মীয় দ্বারা। এই গল্পের জয়ীও তেমনই এক মেয়ে। আশা জাগিয়েও গল্পটি শেষ হয় খানিক গতানুগতিকভাবেই। জয়ী নিজের জোরে উঠে দাঁড়াতে পারলে, সমস্ত ক্লেদ মালিন্য ঠেলে সরিয়ে দিতে পারলে বেশি খুশি হতাম। ‘সহবাসের ডায়েরি’, এও চেনা গল্প। ঠিক নিরুপায় না হয়েও নিরুপায় সেজে থাকা মেয়েদের দেখা যায় অবিরত চারপাশে, যারা অল্প একটু পাশ ফিরবার জায়গার জন্য অনবরত এগিয়ে আসা চৌকাঠটাকে অস্বীকার করে, ঠেলে দেয়, কয়েক ঘণ্টার স্বস্তিই যথেষ্ট মনে করে।
বইটার প্রচ্ছদ, গেট আপ বেশ সুন্দর ছিমছাম, দু-একটা মুদ্রণপ্রমাদ চোখে পড়েছে। আশা করি সেগুলো পরবর্তী সংস্করণে ঠিক হয়ে যাবে। সবমিলিয়ে হাতে নিলে ভালো লাগে। গল্পগুলো সবকটিই সুয়োকথা, সইয়ের লেখার প্রসাদগুণ টেনে ধরে রাখে আগাগোড়া। অসম্ভব সুখপাঠ্য লেখা। বেশ দু-তিনটি গল্পই মনে হয়েছে আরেকটু বাঁধা ছকের বাইরে যেতে পারত, সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু লেখক কী ভেবে যেন আর শেষপর্যন্ত ছকের বাইরে যাননি। এরপরে সইয়ের কলমে কটা দুয়োকথা পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম।
বইটির নির্বাচিত অংশ পড়তে এবং অনলাইন কেনার লিংক পেতে এখানে ক্লিক করুন।
very good.