A+ A-

ভালপারাই

“আকাশে একসাথে এত তারা দেখেছিস কখনও?” শিভাস রিগালের গ্লাসে একটা হালকা চুমুক দিয়ে প্রশ্নটা করল অর্ণব। চোখ আকাশের দিকে। গোটা আকাশটা জুড়ে অক্ষরিকভাবেই থিক থিক করছে অগুনতি তারা। ঘন জঙ্গল অন্ধকারের মধ্যে কাঠ দিয়ে জ্বালানো বন-ফায়ার ঘিরে আমরা ছ’জন। কুরমুর করে কাঠ পুড়ছে। পাশে বসানো বারোবিকিউ-এর স্কিউয়ারগুলিকে মাঝে মাঝে ঘুরিয়ে দিচ্ছি হাত বাড়িয়ে।
আমরা বসে আছি একশ একর বিস্তৃত এ জে বি এস্টেটের মধ্যে একটি হোমস্টে-র উঠোনে। আশপাশে অন্তত চার-পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে কোনও জনবসতি নেই, আমাদের এই থাকার জায়গাটি ছাড়া। যার ফলে এই ঘন অরণ্যের মধ্যে পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া একটা ক্ষীণস্রোতা পাহাড়ি ঝোরার কুলকুল আওয়াজ ছাড়া বাকি সমস্তটা শব্দহীন। শুধু মাঝে মাঝে দূর থেকে ভেসে আসছে জংলি পশুর আওয়াজ।
ক’দিন ধরেই প্ল্যান হচ্ছিল কোথায় যাওয়া যায়! রোজকার অফিসের চাপে ক্লান্তির পরিমাণটা বেশ জমে উঠছিল অনেকখানিই। তাই উইকেন্ড গেটওয়ে হিসাবে খুঁজতে শুরু করেছিলাম আশেপাশে এখনও না যাওয়া জায়গা। এমনিতে প্রায় ছ’বছর চেন্নাইতে থাকার সুবাদে এই অঞ্চলের হিল স্টেশনগুলো আমাদের প্রায় সবই এক বা একাধিকবার ঘুরে ফেলা। আর সপ্তাহান্তে ভিড়ভাট্টা একদম না-পসন্দ। তাই এক রাতের আড্ডায় মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ল ভালপারাই-এর নাম। এই অল্পশ্রুত হিল স্টেশনটির নাম শুনেছিলাম আমারই এক তামিল কলিগের মুখে, বেশ অনেকদিন আগে। সেই শুনে আর গুগলে ছবি দেখে চেকলিস্টে অনেকদিন ধরেই রয়েছিল ভালপারাই। তাই এবার সেই মনোবাসনা পূরণের চেষ্টায় রত হয়েছি।

অর্ণব বেশ কিছু বছর চেন্নাইতে থাকার পর আপাতত ইংল্যান্ডের বাসিন্দা। ইউনিভার্সিটি অফ ইয়র্কে গবেষণারত। বিয়ে করার জন্য দেশে ফিরেছিল কয়েকমাসের জন্য। তার সাথে কিছু ফিল্ডওয়ার্ক সেরে নিতে আপাতত চেন্নাইতে আছে কিছুদিন। অর্ণবের সদ্যবিবাহিতা গিন্নি আমাদেরই আরেক বন্ধু রশ্মি। সাংবাদিকতার কাজ থেকে কিছুদিনের ছুটি নিয়ে মন দিয়ে বিয়েটা করে ফেলেছে। ওদের দুজনের সাথে আমার বন্ধুত্ব বেশ কিছু বছরের। আমার বিয়ের পর আমার গিন্নি, পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, মনীষা যখন চাকরি পালটে চেন্নাই এল, ও-ও আমাদের দলে ভিড়ে সবার বন্ধু হয়ে গেছিল। কিন্তু আমাদের এই চারজনের কখনও একসাথে ঘুরতে যাওয়া হয়নি কোথাও। তাই অর্ণব যখন বলল যে ও এপ্রিল অবধি দেশে তথা চেন্নাইতে থাকছে, আমি ভেবে দেখলুম এই মওকা। তার সাথে আমাদের আর দুই ব্যস্ত বন্ধু, আই আই এমের প্রাক্তনী দেবতনু এবং টাইমস অফ ইন্ডিয়ার ক্রীড়া সাংবাদিক দময়ন্তীকে রাজি করানো হল আমাদের সাথি হওয়ার জন্য। আসলে নানা কারণে সবাই ব্যস্ত থাকলেও সপ্তাহান্তে এই ছোট ছোট বেড়ানোগুলো একটু অক্সিজেন দেয় আর কী! অতঃপর বেশ কিছু রিসার্চ করে মোটামুটি ট্রিপ প্ল্যানটা করে ফেলা গেল। ঠিক হল, চেন্নাই থেকে কোয়েম্বাতুর ট্রেনে গিয়ে তারপর গাড়িতে ভালপারাই। আর অর্ণব এয়ার বিএনবি থেকে খুঁজে পেতে বুক করল জঙ্গলের মধ্যে এই হোমস্টে, ঠিক যেখানে আমরা এখন বসে আছি!
আমাদের এই থাকার জায়গাটি ঠিক ভালপারাইতে নয়। প্রায় কুড়ি কিলোমিটার আগে ডানদিকে চা-বাগানের রাস্তা ধরে নেমে গেল গাড়ি। গাড়ি, অর্থাৎ আমাদের এই ইনোভাটির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন হোমস্টে-র মালিক মিস্টার ভারতী। হ্যাঁ, ছাপার কোনও ভুল নেই, মিস্টার ভারতী। ভারতী খুব কমন তামিল পুরুষ নাম। এ ব্যাপারে এই ফাঁকে আমার একটা মজার অভিজ্ঞতার কথা বলি। তখন সদ্য কলেজের বেড়া টপকে চাকরি জীবনে পা রেখেছি। চেন্নাই আই আই টি-তে পড়লেও ক্যাম্পাসের মধ্যেকার মিশ্র সংস্কৃতির দৌলতে (যার মধ্যে অধিকাংশ উত্তর ভারতীয় এবং তার মধ্যে অধিকাংশ বঙ্গসন্তান) তামিল নাম বা ভাষা কোনওটাই সেভাবে অভ্যাস হয়নি। অতএব চাকরি জীবনে পা রেখে প্রথম বুঝলাম জলের মাছকে ডাঙায় তুললে কী অবস্থা হয়! তো সেই অফিসে একদিন বসে নিজের ডেস্কে। এমন সময় বস এসে বলল, “ওহে গোলগোবিন্দ অলম্বুষ, তুমি তো কুষ্মাণ্ডস্বরূপ আমার গলায় ঝুলে আছ, অতএব তোমার গলা কেন খালি যায়! তোমার গলের মণিহারস্বরূপ একজনকে বেছে রেখেছি। নাম ভারতী। আজ জয়েন করবে।”
নিজের সাবোর্ডিনেট হিসাবে ভারতী নাম্নী কোনও তনয়াকে পেলে কার না পুরুষহৃদয় উদ্বেল হয়ে ওঠে তাকে একটিবার দেখার জন্য! মনে আশা। ‘সে আসিবে, আমার মন বলে’ — এই অবস্থায় কাটল ঘণ্টাখানেক! অতঃপর এক অশ্রুবারিসিঞ্চিত করুণকাহিনি ছাড়া আমার মতো অভাগার ললাটে আর কিছু লেখা ছিল না, তা আমার সহৃদয় পাঠক নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন। এক শ্মশ্রুগুম্ফপূর্ণ মাদ্রাজি আমার গলায় ঝুলল। যাই হোক, সেই থেকে নামের ব্যাপারে আমি সেক্ষপিয়ারপন্থী। নামে কিস্যু যায় আসে না। নাম দেখে ভ্রম করিবেন না।
যাক সে কথা, যা বলছিলাম। এখানে আমাদের হোমস্টে-র মালিক ভারতী একজন বিরলকেশ গোঁফওলা জাহাজ ব্যবসায়ী। আত্মীয়সূত্রে এই একশ একর পাহাড় জঙ্গলে ভরা জমির মালিক। থাকতেন দুবাইয়ে। 2012-তে দেশে ফিরে আপাতত চেন্নাইনিবাসী। স্ত্রী চিকিৎসক। একমাত্র কন্যা অবন্তিকা ক্লাস টেনের পরীক্ষা দিয়ে আপাতত ছুটি কাটাচ্ছে। সেও বাবার সাথে আমাদের আপ্যায়ন করতে এই ক’দিনের জন্য এখানে এসেছে।
বারবিকিউ চিকেন আর শিভাসের সাথে এই তারায় ভরা আকাশতলে নিশ্ছিদ্র শীতল অন্ধকারে আর যে জিনিসটা আমাদের মন মজিয়ে রেখেছিল, তা হল অবন্তিকার আপন মনে গুনগুনানি। কোন এক তামিল গানের কলি গেয়ে চলেছে আগুনের ধরে বসে।

 

২ ||

সেই সাতসকালে ট্রেন এসে পৌঁছেছিল কোয়েম্বাতুর। প্রায় ট্রেনের কামরা থেকেই বগলদাবা করে তুলে নিয়েছিল আমাদের ড্রাইভার পেরুমল। বেশ ঝরঝরে হিন্দি বলে। তামিল টান একটু আছেই। তামিলরা নিজেদের বর্ণমালা অনুযায়ী ‘স’ কে ‘ছ’ বা ‘হ’ কে ‘গ’ বলে ফেলে। তবু কথাবার্তাতে সমস্যা হবে না বুঝে একটু স্বস্তি হল। তার ইনোভা দাঁড়িয়ে ছিল বাইরে। সব জিনিসপত্র পিছনে তুলে দিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হল সাতটা নাগাদ। একশ কিলোমিটার রাস্তা প্রায়। মাঝে চল্লিশ কিলোমিটারের মাথায় আসবে পোলাচি। সেখানের গৌরীকৃষ্ণ রেস্টুরেন্টে জমিয়ে ইডলি, মসলা দোসা লাড্ডু আর তার সাথে তামিলনাড়ু স্পেশাল ফিল্টার কফি দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে মনটা ভালো হয়ে গেল। দিনের মধ্যে ব্রেকফাস্টটা নিয়ে আমি আবার একটু পার্টিক্যুলার। আমার এক সিনিয়র বলত, এক আচ্ছি দিন কি সুরওয়াত এক আচ্ছি ব্রেকফাস্ট সে হি হোতি হ্যায়। এ এক্কেবারে খাঁটি কথা। ব্রেড-বেকন-সসেজ সম্বলিত ইংলিশ ব্রেকফাস্ট আমার সবসময় ফেভারিট। কিন্তু দক্ষিণ ভারতীয় প্রাতরাশও দিব্য লাগে। দোসা ছাড়াও ঘি পোঙ্গল বা রাওয়া উপমা অথবা সেমিয়া খিচুড়ি ব্রেকফাস্টকে এক অন্য পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে।

যাই হোক, খাওয়ার কথায় যাওয়া ভুলেছি। পোলাচিতে পেটভরে খেয়ে আমাদের আবার যাত্রা শুরু হল। এবার আস্তে আস্তে পাহাড়ে ওঠার পালা। আনাইমালাই টাইগার রিজার্ভের গেট পার হয়ে গাড়ি ঢুকল জঙ্গলের রাস্তায়। অবশ্য জঙ্গলের রাস্তা বললে যেরকম রাস্তা মনে হয়, এ রাস্তা একেবারেই সেরকম না। চকচকে মসৃণ পিচের চওড়া রাস্তা দু’দিকে জঙ্গলের বুক চিরে ধীরে ধীরে উঠে গেছে পাহাড়ের কোল বেয়ে। পিছনে ফেলে আসা আলেয়ার বাঁধ অনেক উঁচু থেকে ছবির মতো মনে হয়। হেয়ারপিনের বাঁক ঘুরে গাড়ি উঠতে থাকে। এই রাস্তায় নাকি চল্লিশটা হেয়ারপিন বেন্ড আছে সব মিলিয়ে। একটু সুন্দর জায়গা দেখলেই রাস্তার পাশে থামিয়ে দিতে থাকলাম গাড়ি। একটু নেমে গা-হাত-পা ছাড়িয়ে নেওয়া আর কী!
এরকম এক বাঁকে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়েছি খাদের ধারে। অনেক নিচে আলেয়ার বাঁধের জলের উপর রোদ পড়েছে। তার চারপাশ দিয়ে ধাপে ধাপে দিগন্তে গিয়ে মিলিয়ে গেছে আনাইমালাই পর্বতমালা। আমার ক্যামেরাটি কিছুদিন আগে দেহ রেখেছে। তাই পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে ছবি তুলব ভাবছি, এমন সময় পাশে চোখ পড়তেই তাঁর দেখা। মাথায় দুটি বাঁকা শিং। থুতনিতে এক বিঘৎ দাড়ি। নিবিষ্ট মনে কিছু একটা চিবোতে ব্যস্ত। একটি নীলগিরিতাড়। জাতিতে ছাগল। বিশেষ প্রজাতির। এই অঞ্চলেই দেখা মেলে। কিন্তু অজরাজের বোধ হয় আমাকে ঠিক মনে ধরল না। উঠে চলে গেলেন।

নীলগিরিতাড়
একটানা প্রায় আড়াই ঘণ্টা চলার পর গাড়ি হঠাৎ রাস্তা ছেড়ে নেমে পড়ল একটা সিংগল রোডে। এতক্ষণ যে চা-বাগানগুলো দূরে পাহাড়ের কোলে দেখছিলাম, তারা দু’পাশে এখন। রাস্তা খানিকটা নেমে আবার উঠে গেছে সামনের পাহাড়ের গা বেয়ে। পুরো পাহাড়টাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন একটা সবুজ জামা পরে আছে। পুরো পাহাড়টাই চা গাছে ভরা। মাঝে মাঝে জলের ব্যবস্থা করা। কৃত্রিম কিছু নয়, উপর পাহাড়ে বৃষ্টি হলে গা বেয়ে নেমে আসা সেই জলকে গোটা ক্ষেতময় সেচের কাজে লাগানোর সব আদি উপায়।
একসময় চা-বাগান শেষ হয়ে এল। এবার জঙ্গলের মধ্যে সরু রাস্তা। একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে খাদ। আর কতদূর! পেরুমলকে জিজ্ঞেস করে এতক্ষণে জানা গেল যে, সেও রাস্তা চেনে না। সে কোয়েম্বাতুরেরই এক ট্রাভেল এজেন্সির হয়ে কাজ করে। আমাদের হোমস্টে-র মালিক ফোন করে শুধু আমাদের নিয়ে আসতে বলেছেন। মোটামুটি একটা পথনির্দেশ দিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা যে এরকম সরু আর এবড়ো খেবড়ো রাস্তা দিয়ে এতটা পথ, তা বোধ হয় বলেননি। আমরা বারবার ফোন করার চেষ্টা করতে লাগলাম মিস্টার ভারতীকে। সিগনালও স্টেবল নয়। আসে যায়। কোনওমতে পাওয়া গেল একবার। কথা বলে বুঝলাম ঠিক রাস্তাতেই আছি। আরও দুই কিলোমিটার গেলে এস্টেটের গেট দেখতে পাব। গেট থেকে আমাদের থাকার জায়গা আরও খানিকটা ভিতরে।
এস্টেটের গেট পাওয়া গেল একটু পরেই। কিন্তু সেখান থেকে মূল রাস্তা ছেড়ে ভিতরের রাস্তাটি সমতলের সাথে প্রায় ষাট ডিগ্রি কোণ করে উঠে গেছে। পাথরের রাস্তা। আমাদের ইনোভা কিছুটা উঠে বিপজ্জনকভাবে গড়িয়ে চলে এল পিছনে। কোনওক্রমে ব্রেক কষে বিপদ থেকে বাঁচাল পেরুমল। বলে দিল, এ গাড়ি উঠবে না। উঠলেও শুধু গাড়ি উঠবে, এত লোক নিয়ে উঠবে না। তাহলে যাব কী করে?
ঠিক এই সময় সামনের গাছে হঠাৎ লম্ফঝম্ফ। কে রে! তাকাতেই দেখি কুচকুচে কালো দেহ আর সিংহের কেশরের মতো মুখের চারপাশে দাড়ি নিয়ে কয়েকজন ভদ্রলোক আমাদের অভ্যর্থনা জানাবেন বলে উঁকিঝুঁকি মারছেন। শুনেছিলাম এই অঞ্চলে এঁদের দেখা পাওয়া যায়। প্রায় অবলুপ্তির পথে এগিয়ে চলা লায়নটেল ম্যাকাক। এক প্রজাতির হনুমান। সিংহের মতো লেজ এবং কেশর থাকার জন্যে এরকম নামকরণ। তা, এনারা আমাদের একটু উঁকিঝুঁকি দিয়ে নিজের নিজের কাজে অন্য অন্য গাছে উঠে পড়লেন। আমরা আবার ‘যাব কী করে’র চিন্তায় বিভোর হয়ে পড়লাম।

 

৩ ||

মধুসূদনদাদার সেই গল্পটা মনে আছে? একটি বাচ্চা বনের রাস্তা খুঁজে না পেয়ে কাঁদছিল, তখন মধুসূদনদাদা এসে তাকে সঙ্গ দিয়ে রাস্তা চিনিয়ে দেয়। এই ব্যাপারটা কী রকম হয়, তার একটা অভিজ্ঞতা আমার আছে। সেই গল্প বলি শুনুন।
তখন আমি সদ্য ক্লাস ফোর টপকেছি। ফাইভে হাই স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্টের আশায় কিছুদিনের ব্রেক। তখন বাবা প্ল্যান করল সিকিম যাওয়ার। এই প্রথম যাওয়া নয়। আগেও বারদুয়েক যাওয়া হয়েছে। তবু এবারের আকর্ষণ ছিল অন্য। পশ্চিম সিকিমে পাহাড় জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ট্রেকিং। জায়গাটার নাম ভার্সে বা ভোর্সে। এখন হয়তো অনেকেই যান বা গেছেন, কিন্তু আমি যখনকার কথা বলছি, প্রায় কুড়ি বছর আগে, তখন এখানে ট্যুরিস্টের পা খুব কম পড়ত। শোরেং থেকে সতেরো কিলোমিটার চড়াই বেয়ে ভার্সে। পরদিন সকালে পাঁচ কিলোমিটারের মতো নেমে গিয়ে দেন্তাম বলে একটি জায়গায় আমাদের ট্রেকিং শেষ। প্রথমদিন প্রচণ্ড ক্লান্ত হলেও উদ্ধত সব রডোডেন্ড্রগুচ্ছের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ঠিকভাবেই পৌঁছে গেলাম ভার্সে। বিপত্তি বাধল পরের দিন দেন্তাম যাওয়ার সময়। এ রাস্তাও জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। এক লোকাল গাইডের নিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সকালবেলা যাত্রা শুরুর সময় দেখা গেল যে, রাতে দু-চার পেগ বেশি হয়ে যাওয়ার দরুণ তিনি বেপাত্তা। অতঃপর আপনা হাত জগন্নাথ! নিজেরাই বেরিয়ে পড়লাম। এবং ক্রমে পথ হারিয়ে আমরা শ্বাপদপূর্ণ পাহাড়ি জঙ্গলে যাকে বলে পুরো লস্ট! প্রায় দু-তিন ঘণ্টা জল-কাদা-বৃষ্টি-জোঁক সমস্ত কিছুর সাথে লড়াইয়ের পর যখন হাল ছেড়ে দেব-দেব ভাবা হচ্ছে, তখন তাঁদের সাথে দেখা। হ্যাঁ মশাই, দেবদূত। জনমনিষ্যিহীন প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে ঘন জঙ্গলের মধ্যে তিন কাঠুরে। হাতে কুড়ুল নিয়ে তাদের মধ্যেই একজন আমাদের সাথে করে নিয়ে রাস্তা চিনিয়ে আরও দুই ঘণ্টার মধ্যে নিয়ে ফেলল মূল রাস্তায়। কিন্তু, বললে বিশ্বাস করবেন না, তাকে ধন্যবাদ দেওয়ার অবকাশটুকু পাইনি। রাস্তা খুঁজে পাওয়ার আনন্দ কাটিয়ে তার দিকে ফিরে দেখি সে আবার মিলিয়ে গেছে জঙ্গলের বুকে। এখন মনে হয় জীবনে মাঝে মাঝে হারিয়ে যাওয়াটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট। হারিয়ে যাওয়ার মধ্যে একটা যে নিপাট বিশুদ্ধ থ্রিল আছে শুধু তাই নয়, নিজের মানবসত্তাটা একবার ঝালিয়ে নেওয়া যায়। অনন্ত বিশাল প্রকৃতির মাঝে আমি কে, আমার ক’টা ডিগ্রি বা মাস গেলে কত মাইনে পাই, এ সমস্ত কিছু গৌণ হয়ে যে বোধ জন্ম নেয়, তা হল আমি মানুষ (এ ব্যাপারে ‘আরণ্যক’ ছবিতে পাহাড়ি সান্যালের বাড়িতে প্রথমবার ঢোকার সময় বাচ্চাটির প্রশ্নে রবি ঘোষের উত্তরটির কথা মনে করুন)। আর উপরি হিসাবে এরকম কিছু মধুসূদনদাদাদের দেখা পাওয়া যায়, বাকি জীবনের জন্য একটা কাহিনিও জন্ম দিয়ে যায়।
ভালপারাই-এর রাস্তায় জঙ্গলের মধ্যে ওরকম চড়াই থেকে পিছলে নেমে এসে পেরুমল যখন জবাব দিয়ে দিল, তখন ‘হা হতোস্মি’ করে বসে থাকা ছাড়া উপায় ছিল না। ঠিক সেই সময় রথসহ দেবদূতের মর্ত্যাগমন। আমাদের হোমস্টে-রই একটি ফোর হুইল ড্রিভেন গাড়ি গড়গড়িয়ে নেমে এল। যাচ্ছিল শহরের দিকে বাজারে। তাকে দাঁড় করিয়ে বোঝানো হল সমস্যার কথা। সে রাজি হয়ে গেল আমাদের উপরে রেখে আসতে। অতএব জিনিসপত্র পেরুমলের জিম্মায় দিয়ে আমরা ছ’জন উঠে পড়লাম এটাতে। পাহাড় বেয়ে গড়গড়িয়ে উঠে চলল। পিছনে ফাঁকা গাড়িতে শুধু আমাদের জিনিসপত্র নিয়ে পেরুমল।
পাহাড় বেয়ে প্রায় দুই কিলোমিটার উঠে যাওয়া হল। রাস্তা পুরোটাই প্রায় ষাট ডিগ্রি খাড়াই। শেষের দিকে এঁকেবেঁকে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেছে। দিনের বেলাই বেশ গা ছমছমে। রাতে না জানি কেমন হবে, এই ভাবতে ভাবতে আমাদের থাকার জায়গায় পৌঁছলাম। আশেপাশে একটা সার্ভেন্টস কোয়াটার্স জাতীয় চালাঘর ছাড়া আর কোনও লোকালয় নেই। হোমস্টে-র সামনে বেশ একটা বড় চাতাল। তারই একদিকে গাড়ি রাখার জায়গা। তারপরে প্রায় ষাট-সত্তর ফুট নিচু খাদ। তার নিচ দিয়ে কোথাও একটা ঝোরা বয়ে চলেছে। তার একটানা কুলকুল আওয়াজ কানে আসছে, কিন্তু জল দেখতে পেলাম না। উলটোদিকের পাহাড়টা অন্য আর একটি এস্টেট। পাহাড়ের ঢালে কফি চাষ হয়েছে। আমাদের উঠোনে কফি বিনস ঢালাও শুকোতে দেওয়া রয়েছে।
গাড়ি এসে থামতেই টাক মাথা, বেঁটেখাটো মিস্টার ভারতী এগিয়ে এসে অভ্যর্থনা জানালেন। বাড়িটি একচালা। ভিতরে ব্যবস্থা ভালোই। ইলেকট্রিসিটিও আছে দেখলাম। যদিও ফ্যানের দরকার হবে না বলেই বুঝলাম। রাতে শুধু লাইট লাগবে। মোবাইলে কোনও টাওয়ার নেই। সুতরাং সেগুলোকে ক্যামেরা হিসাবেই ভাবতে হবে। মিস্টার ভারতী আমাদের ঘরগুলি দেখাতে নিয়ে ভিতরে ঢুকলেন। ততক্ষণে পেরুমল অনেক কষ্ট করে তার ইনোভা তুলে ফেলেছে। ঘর তিনটে। সামনেই একটা প্রকাণ্ড ঘর। ভিতরে ছোট ছোট আরও দুটি ঘর। সব ক’টা ঘরের সাথেই একেবারে আধুনিক বাথরুম। সেখানে গরম জলের সুন্দর ব্যবস্থা। গিজার নেই, বাড়ির পিছনে কাঠের আগুনে জল গরম হয়ে পাইপ বেয়ে আসছে বাথরুমের কলে। সকালে সেই পোলাচিতে করা ব্রেকফাস্ট এই এতক্ষণের জার্নিতে হজম হয়ে গেছে। পেটে ছুঁচোগুলো শুধু ডন নয়, দু-চারটে সিট আপ মেরেও ফেলেছে। তাই আর না পেরে ভারতীকে শুধোই, “এঁ হে হে, মানে ব্যবস্থা তো ভালোই। কিন্তু খাওয়াদাওয়া…”
ভারতী তাই শুনে খাওয়ার যা ফিরিস্তি দিলেন, অনেক কষ্টে নোলাকে সামলে রাখতে হল। লাঞ্চে সাদা ভাত, চিকেন বিরিয়ানি, ফিশ কারি, চিকেন শুক্কা আর কিছু একটা ভেজ সব্জি। এমন জঙ্গলের মধ্যে, আক্ষরিক অর্থে মিডল অফ নোহোয়ার যাকে বলে, সেখানে এমন খাবার ফিরিস্তি শুনে মুখ থেকে বেরিয়েই যাচ্ছিল প্রায় যে ‘এহত কিহি দহরকার ছিহিল।’ কিন্তু গ্যাঁট থেকে আমাদের প্রতিদিন পাঁচশ টাকা খাবার খরচাটা কন্সট্যান্ট জেনে আর কিছু বললাম না। তবে ভারতী যে আমাদের মনের কথাটা বুঝে সেটা পরদিন থেকে অ্যাপ্লাই করে বসবেন সেটা ঠাহর হয়নি। সে কথা যথাসময় বলব। এখন চটজলদি স্নান সেরে ঘণ্টাদেড়েকের মধ্যে সব্বাই হাজিরা দিলাম খাবার টেবিলে।

আজ আর কিছু সেরকম করার নেই। সন্ধে হয়ে গেলে এখানে গাড়ি নিয়ে ফেরা মুশকিল। ভারতী বারণ করলেন। বললেন, “আজ এখানেই থাকুন। সন্ধেবেলা বনফায়ার আর বার্বিকিউ করে সময় কাটান। রাতে চাপাতি আর মুর্গি খান। সকালে বেরোবেন ভালপারাই বেড়াতে।” আমরাও বেশ ক্লান্ত। একে তো ভোরবেলাতে ওঠা। তারপর এতটা রাস্তা গাড়িতে ট্রাভেল। ভারতীর বি এস এন এল ফোন থেকে যে যার বাড়িতে খবর দিয়ে সভ্যতার সমস্ত পিছুটান কাট-অফ করে দিলাম। সেটাতেও একটা পাথরের উপর থেকেই মাত্র টাওয়ার ধরে। জোরে হাওয়া দিলে তাও উড়ে যায়।
সামনের ঘরে বসে গুলতানি করে কাটিয়ে দেওয়া গেল রোদবেলাটুকু। ‘রোদবেলা’ শব্দটা শুনতে যতটা মধুর, এই তামিলদেশে এই রোদবেলাটুকু বছরভর ততটাই ভয়ঙ্কর। এমনকী জানুয়ারি মাসেও। সে শুধু চেন্নাই বলেই নয়, আমি যত জায়গায় গেছি সর্বত্র — মায় উটি অবধি। প্রাণটা একটু ছায়া সুশীতল শান্তির নীড় (আর নীরও বটে!) খুঁজতে চায়।
বিকেলে সামনের চাতালে জমিয়ে ক্রিকেট খেলা শুরু হল। ব্যাট বলতে একটা ভাঙা পিভিসি পাইপের টুকরো, আর বল হল কখনও গোলচে স্টোনচিপ অথবা কফির ক্ষুদ্র বিন। হাসবেন না, মশাই — পার্ফেকশন লাগে। যাই হোক, আমাদের এই সুবিশাল ক্রিকেটের রাজসূয় যজ্ঞ ফ্লাড লাইটের অভাবে বন্ধ হলে আমরা বারবিকিউ-এর জন্য উৎসাহিত হয়ে পড়লাম। জঙ্গলে অন্ধকারটা বেশ ইন্টারেস্টিং লাগে আমার। ধ্বন্যাত্মক অব্যয় দিয়ে বললে যাকে বলে ‘ঝুপ করে’ অন্ধকার নেমে আসে। এখানেও সেই। সূর্য হারিয়ে গেছে পাহাড়ের পিছনে। আস্তে আস্তে পাহাড়ের ছায়াগুলো লম্বা হয়ে ঢেকে ফেলছে সব। দূরে হাতির ডাক শোনা গেল। জঙ্গল জাগছে। আর ঠিক এই সময় সভ্যতার শেষ দীপটুকুর মতো যে আলোটুকু ছিল, সেটাও নিভে গেল।
লোডশেডিং!

 

৪ ||

“নিশ্ছিদ্র অন্ধকার!” রশ্মি বলল। লোডশেডিং পরবর্তী অন্ধকারে এই শব্দবন্ধর আসল মানে বুঝলাম। ছোটবেলা থেকে পাহাড় জঙ্গল প্রচুর ঘুরেছি। হিমালয়ে সিকিম থেকে কাশ্মীর অবধি ঘুরে ফেলেছি অনেকটাই। এরকম ‘নিশ্ছিদ্র অন্ধকার’ দেখার সৌভাগ্য হয়নি কখনও।
শব্দবন্ধটা বলে রশ্মি গল্প বলছিল একটা। ও প্রথম, মানে ওর স্মৃতি অনুযায়ী প্রথম, এই শব্দবন্ধটা শোনে সেরিখোলা নামে হিমালয়ের কোলে একটা জায়গায় বেড়াতে গিয়ে, ওর মায়ের কাছে। সেবার রিম্বিক আর সেরিখোলা গিয়েছিল ওরা। ও তখন ক্লাস সিক্স। অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ১৮ বছর আগের কথা। তখনও অত ট্যুরিজম ডেভেলপ না করা রিম্বিক বা সেরিখোলা হিমালয়ের আর পাঁচটা গ্রামের মতোই অখ্যাত। সেরিখোলাতে একটা পাহাড়ি নদীর পাড়ে একটা কাঠের ট্রেকার্স হাট ছাড়া কিছু নেই। সামনে একটা কাঠের সাঁকো পার হয়ে খাওয়ার জায়গা। বিকেলে সবাই সেখানে জড়ো হয়েছিল একটু আগুনের ওমের লোভে। ওখানেই গল্পগাছা করতে করতে বাইরে যে কখন অন্ধকারের চাদর নেমেছে বোঝা যায়নি। নৈশাহার সেরে বাইরে পা দিয়েই মনে হল সামনে অন্ধকার জমাট বেঁধে যেন দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে। মা বললেন, নিশ্ছিদ্র অন্ধকার! সেই থেকে শব্দটা গেঁথে গেছে মনে।
এইসব টুকটাক গল্পগাছা চলছিল আগুনের চারপাশে বসে। আমাদের ক’জন ছাড়া ‘জগতে কেহ যেন নাহি আর!’ পাশে বারবিকিউ হচ্ছে। মাঝে মাঝে শিক থেকে মাংসের টুকরো নিয়ে মুখে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। আকাশে অসংখ্য তারা আমাদের মাথার উপরে চাঁদোয়ার মতো ঝুলে আছে। খানিকটা নিচ থেকে সেই অদর্শিত ঝোরার কুলকুল করে একটা মৃদু শব্দ আবহ সঙ্গীতের মতো বেজে চলেছে এই প্রেক্ষাপটে। দূরে কোথায় হাতি ডাকল। আমরা সবাই আগুনের দিকে ঘেঁষে বসলাম। হঠাৎ একটা খচমচ শব্দে সবার কান খাড়া হয়ে উঠল। ঠাহর করে বোঝা গেল আওয়াজটা আসছে উঠোন পার হয়ে যে ঢালু জমিটা নেমে গেছে নিচে, খাদের মধ্যে, সেখান থেকে। শব্দ শুনে মনে হচ্ছে কোনও চারপেয়ে খুব সন্তর্পণে হেঁটে যাচ্ছে। আর পায়ের তলায় শুকনো ডালপালাগুলো ধীরে ধীরে ভাঙছে। ভাবলাম, টর্চ মেরে দেখে আসি। মনীষা খপাৎ করে হাত ধরে বসিয়ে দিল। “খবরদার। কোনও পাকামো করবি না! যদি লেপার্ড হয়?” আমি বলার চেষ্টা করছিলাম যে লেপার্ড নয়, ম্যাক্সিমাম বনবিড়াল হবে। আর হলেও আলো দেখলে কেউ কাছে ঘেঁষবে না। কিন্তু ওই আর কী! এইসব কুযুক্তিকে ফুৎকারে উড়িয়ে বলল, “না!” আর কী করা! স্ত্রীর কথা অমান্য করে কবে কোন পুরুষ সফল হতে পেরেছে! এইসব স্ট্যাটিস্টিক্যাল ডাটার কথা ভেবে ভালো ছেলের মতো হাল ছেড়ে বারবিকিউতেই মন দিলাম।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল ছ’টায়। সদ্য আলো ফুটেছে। আমি আর মনীষা প্ল্যান করেই রেখেছিলাম যে মর্নিং ওয়াকে যাব। বেড়াতে এলে, বিশেষত এমন জঙ্গুলে জায়গায়, ভোরবেলা ওঠাটা শ্রেয় মনে করি।
গায়ে জ্যাকেটটা গলিয়ে চাতালে এসে দাঁড়াই দুজনে। শব্দ শুনে মনে হচ্ছে কনসার্ট বসেছে। নানারকম পাখির ডাক। একটা চেস্টনাট হেডেড বীইটার আর একটা বুলবুল চাতালের ওপর বসে গল্প করছিল। আমাদের দেখে উড়ে গেল। মানুষ নামক জন্তুটা সবার কাছেই খুব অসহ্য।
পাহাড় হেঁটে উঠে গেলাম ওপরের দিকে কিছুটা। জঙ্গল ধীরে ধীরে পায়ে চলা রাস্তাটাকে গিলে নিয়েছে। বনপথের ধারে ফুটে আছে নাম-না-জানা জংলা হলুদ ফুল। তারই কেশরে বনতল ফুলে ফুলে ঢাকা।
কিছুটা গিয়ে ফেরার পথ ধরি। দেবতনু উঠে এসেছে দেখলাম। তিনজনে নেমে আসি চাতালে। দেবতনু গৃহকর্মনিপুণ ছেলে। সকালে উঠে চা বানিয়ে ফেলে আমাদের খুঁজতে আসছিল। আমি আবার না-চার দলে (তা বলে আমায় ‘নো-টী’ বলে ভুল করবেন না)। চাতালে বসে ওরা গরম চায়ের কাপে চুমুক দিল। আমি সেই ফাঁকে রাতে সেই অজানা পশুর পদচারণের শব্দর উৎসস্থল খোঁজার অসফল চেষ্টা করতে লাগলাম।
আজ আমাদের প্ল্যান ভালপারাই শহরের দিকে যাওয়ার। সোলায়ুর বাঁধ দেখে আসব। লাঞ্চ বাইরেই হবে। ব্রেকফাস্টটা সেরে বেরিয়ে পড়া। ব্রেকফাস্টে দেখলাম প্লেন দোসা (ফোড়ন হিসাবে বলে রাখি, বাঙালিরা Dhosa বানান দেখে বস্তুটিকে ধোসা বলে জানি। কিন্তু ইহার আসল উচ্চারণ হল, দোসা। তামিলরা অকারণে শব্দের মধ্যে অস্থানে কুস্থানে ‘h’ লাগিয়ে ফেলেন। সেই ‘হেইচ’গুলিকে পদার্থবিদ্যার হিসাবের মতো ক্ষুদ্র বলে উপেক্ষণীয় ধরাই সমীচিন।)। সাথে ইডলি, সাম্বার, আর এদের বিখ্যাত নারকেল সমৃদ্ধ হোয়াইট চাটনি। তামিল ব্রেকফাস্ট জিনিসটা আমার কাছে পুরো ‘১০০ পার্সেন্ট লাভ’, আগেই বলেছি। অতএব ঠুসে ব্রেকফাস্ট করে নিয়ে তৈরি হয়ে নিলাম সবাই। এগারোটা নাগাদ আবার হেঁইসো জোয়ান। ইনোভার অবস্থা সেই সহজ পাঠের ‘দন্ত্য ন’-র মতো। ‘রেগে বলে দন্ত্য ন, যাব না তো কক্ষনো!’ কিছুতেই উঠতে চায় না। হড়হড় করে নেমে আসে। সুতরাং ভরসা সেই চারচাকা চালিত মাহিন্দ্রা। আমাদের মূল রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে সে বাজারে চলে গেল। আমরা ইনোভাতে চেপে চললাম শহরের দিকে।
অত”পর চাবাগান, ফোনের সিগনাল, রাস্তার ধারে গৌর (না না, নিতাই বা নিমাই এর সাথে কোনও সম্পর্ক নেই এনার। ইনি একটি চারপেয়ে। এনার আফ্রিকান জাতভাইয়ের নাম বাইসন। সুতরাং ব্যাপারটা যতটা অহিংস মনে করছিলেন, ঠিক ততটা নয়!) এবং আবার আবার চা-বাগান দেখে আমরা যারপরনাই উৎফুল্ল হয়ে পড়লুম। এতটা আনন্দিত হয়ে মাঝে একবার পথ ভুল করে ফেলেছিল পেরুমল। ব্যাপারটা wrong turn-এর দিকে এগোনোর আগেই অবশ্য শুধরে নেওয়া হয়েছিল। গাড়িতে উঠে পাহাড়ে পাক খাওয়া শুরু হলেই দেবতনু আর দময়ন্তী একটু গম্ভীর হয়ে যায়। সে ব্যাপারে বিস্তারে যাওয়ার দরকার সেরকম নেই। বাকিটা আভোমিন জানে।

 

৫ ||

সোলায়ুর বাঁধের ওপর থেকে অনেকটা নিচে জল দেখে বেশ একটা শান্তি অনুভব করলাম। মাথার ওপর প্রচণ্ড সূর্য। দু’চোখে জলরাশি দেখে প্রাণটা যেন জুড়িয়ে যায়।
চালাক্কুডি নদীর ওপর এই বাঁধ। ভালপারাই থেকে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার দূরে — আমরা যেদিকে আছি, সেদিকে না। অন্যদিকে। পাহাড়ের গা বেয়ে অসম্ভব সুন্দর সবুজে মোড়ানো রাস্তা দিয়ে আসতে আসতে দেবতনু একটু কাবু হলেও, নেমে বেশ ভালো লাগল সবার। দূরে নিচে জল। দেখেই মনে হচ্ছে ঝাঁপাই। এই প্রচণ্ড গরমে এর চেয়ে ভালো কিছু হতে পারে না।

সোলায়ুর বাঁধ

তামিলনাড়ুর হিল স্টেশনের এই হল সমস্যা। দিনের বেলায় প্রচণ্ড গরম, রাত পড়লে হালকা ঠান্ডা। ফলে সোয়েটার পরা বা খোলা নিয়ে একটা সমস্যা তৈরি হয়। আর তার চেয়েও বেশি সমস্যা হল, হিল স্টেশনের ফর্মুলা মেনে একটাও হোটেলে ফ্যান বা এসি থাকে না। ফলে দিনের বেলা কেমন যেন একটা ‘ছেড়ে দে মা, কক্ষনও আসব না আর’ অবস্থা দাঁড়ায়। বিশেষ করে এই ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবরের মধ্যে গেলে।
আমরা সূর্যাতপ বেশিক্ষণ সহ্য না করতে পেরে গাড়িতে সেঁধোই। গাড়িতে উঠে বুঝতে পারি যে ব্রেকফাস্টটা হজম হয়ে গেছে। সুতরাং পেরুমলকে বলি, সিধা ভালপারাই শহরে চলো। খাব!
ছোট শহর হওয়ার দরুণ ভালো সেরকম খাওয়ার জায়গা নেই। একটা জায়গা আমাদের হোমস্টে-র মালিক ভারতী বলে দিয়েছিলেন। সেখানেই গেলাম। মোটামুটি। বেশ বেলা হয়ে যাওয়ায় খাবারের অপশন কমে এসেছিল। ফ্রায়েড রাইস আর গ্রেভি দিয়ে চটপট খেয়ে নিলাম।
বাকি দেখার জায়গাগুলো আমাদের ফেরার রাস্তায় বলে সেগুলো কালকের জন্য তুলে রেখে শহরের মধ্যে একটু দোকানপাট ঘুরে দেখে ফেরার পথ ধরলাম।
ফেরার সময় কন্যাত্রয় বললেন যে, তাঁরা চা-বাগানে নেমে ছবি তুলবেন। অতএব আমরা পথের ধারে গাড়ি থামিয়ে ছবি তুলতে ঢুকলাম চা-বাগানে।

সন্ধে হবে-হবে এরকম একটা সময় আমরা হোমস্টেতে পৌঁছলাম। সন্ধেবেলা বার্বিকিউ চড়িয়ে আবার বসলাম আড্ডায়। চারিদিকে আলো থাকার দরুণ আকাশের আলো আজ ম্লান। কয়েকটা তারা দেখা যাচ্ছে। গতকালের সেই গা ছমছমে ব্যাপারটার ছিটেফোঁটাও কোথাও লাগল না।
এর মধ্যে দেবতনু ঠিক করেছে যে, সে ডিমের ঝোল বানাবে। গুনে দেখা গেল গোটা আটেক ডিম আছে। ডিম ছাড়া মাংসের ঝোল আর রুটি। ভারতী আমাদের মনের কথা বুঝে পদ কমিয়ে দিয়েছেন তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ আড্ডার পর যখন খেতে বসা হল, তখন আবিষ্কার করা গেল আমাদের ছ’জনের জন্য চারটি ডিম রেখে বাকিগুলো ভারতী এবং বাকিরা উদরসাৎ করেছেন। অর্ণব আর রশ্মি বেজায় খচেমচে বলল, খুব খারাপ রেটিং দেবে আর রিভিউ লিখবে। ডিম ব্যাপারটা ওদের দুজনের হৃদয়ের কতটা কাছের, সেটা যারা ওদের চেনেন না, তাঁরা বুঝবেন না।
চারটে ডিম ভাগযোগ করে খাওয়া চলছে, এমন সময় হঠাৎ একটা প্রচণ্ড রকম দৌড়াদৌড়ির আওয়াজ। এবং আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, আওয়াজ আসছে আমাদের মাথার ঠিক উপরে অ্যাসবেস্টাসের চালের উপর থেকে। এরকম জঙ্গুলে জায়গায় গভীর রাতে মাথার উপর নাচে কেডা!
একটু পরেই তাদের দেখা গেল। এবং আমাদের বীরাঙ্গনা কন্যাত্রয় খাবার টেবিল ছেড়ে এক লাফে খাটে গিয়ে উঠল, যেন খাটে উঠলে ইঁদুরের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়! সত্যি বলছি, মশাই। এই একহাত লম্বা প্রায় এক-একটা ইঁদুর। কী খায় কে জানে! এরকম বোম্বাই ইঁদুর, পুজোপ্যান্ডেলে গণেশের পায়ের কাছে ছাড়া, এরকম লাইভ অ্যাকশনে বাপের জন্মে দেখিনি, মাইরি বলছি। মাঝে মাঝেই তারা চালের ফাঁক গলে নেমে আসছে। আর তাড়া খেলেই লাফিয়ে উঠে পড়ছে চালের উপর। সারারাত কী নৃত্য! মনিপুরী থেকে ভোজপুরী — সবরকম! গতকাল বিদ্যুৎহীন ঘুটঘুটে অন্ধকারে এদের কোনও লেজের ডগাও দেখা যায়নি, আজ কোথা থেকে এসে জুটল বনলক্ষ্মীই জানেন।
ভারতীকে দরজা খটখটিয়ে বলা হল। এ কেমন আতিথেয়তা বাপু! ডিম খেয়ে নিয়েছ, কিছু বলিনি। তা বলে ইঁদুর ছেড়ে দেবে! ভালোমানুষের পো পেয়ে ইল্লি হচ্ছে নাকি! সে ঘুম চোখে উঠে খচমচ করে টর্চ জ্বেলে ইঁদুর পর্যবেক্ষণ করে বলল, এগুলো এখানেই থাকে। কিছু করবে না। ঘুমোন গে যান।
মানে! সে তোমার পোষা হতে পারে, আমাদের তো নয়। এই নিয়ে বিস্তর বাগবিতণ্ডার পর ইঁদুর নিয়ে যখন কোনও আশু সমাধান খুঁজে পাওয়া গেল না, যে যার ঘরে গুটিগুটি ঢুকে আলো জ্বালিয়ে রেখেই শুয়ে পড়া হল।
তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, খেয়াল নেই।

চোখ খুলে দেখি ভোর হয়ে গেছে। বাইরে পাখিদের কনসার্ট শুরু হয়ে গেছে। মনীষা আর দেবতনুকে ডেকে তুলে হেঁটে এলাম খানিকটা। জঙ্গলের ঘনান্ধকার রাতের যেরকম একটা রহস্যময়তা আছে, ভোরটা ততটাই নির্মল, হাস্যমুখর। সমস্ত প্রকৃতি যেন জেগে উঠে হাসছে, আর তার সেই হাসি অনুরণিত হয়ে পাখিদের গান হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে আকাশ জুড়ে। একটা নরম ভোর। শিশির ভেজা গতরাতের আগুনকুণ্ডটার ভিতর থেকে ধিকিধিকি ধোঁয়া একটু একটু করে বের হয়ে আসছে। তার চারপাশ দিয়ে একটা খঞ্জনা লেজ দুলিয়ে দুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যাকে ইংরিজিতে বলে ইয়েলো ওয়াগটেইল। পাহাড়ের ওপার থেকে সূর্যটা উঠে পড়লেই এই সমস্ত মেদুরতা ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে শুরু হয়ে যায় রোদের গনগনানি।
আমরা ঠিক করেছিলাম লাঞ্চ করে বের হব। রাত দশটা চল্লিশে ট্রেন। ফেরার পথে আলেয়ার বাঁধ দেখে নেব। সেই মতো সকালটা হইহল্লা করে উঠোনে যথাক্রমে ক্রিকেট, কুমিরডাঙা, কবাডির রীতিমত বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপের আসর বসিয়ে সময় কাটানো গেল।
তারপর নেমে আসা। আবার সেই খাড়াই রাস্তা বেয়ে নিচে নামা, চা-বাগান, ফেলে যাওয়া আনাইমালাই টাইগার রিজার্ভ। আলেয়ার বাঁধে চড়ে কাটানো গেল বিকেলটা। সাথে ছিল দেবতনুর নির্দেশ মতো বানানো ঝালমুড়ি।

অতঃপর ফিরে চলা ঘরের টানে। রাতের ট্রেন ধরি কোয়েম্বাতুর থেকে। প্রকৃতির গভীরতা থেকে পা রাখা নাগরিকতার প্রবেশদ্বারে, যেখানে ত্রস্তভাবে পালটে চলা ক্যালেন্ডারের পাতার সাথে জীবনের লাভক্ষতির পাটিগণিত। সাথে শুধু অপেক্ষা, আবার কবে এই হৃদমাঝারে জমা কার্বন ডাই অক্সাইড দূর করতে বেরিয়ে পড়ব, বেরিয়ে পড়ব জীবনের জন্য রসদ নিতে। তার সাথে সঞ্চিত হবে বহু না-জানা গল্প, না-দেখা তারার আলো আর অনেকখানি না-স্পর্শ-করা ভালোলাগা। এই জন্যই জন্যই তো বেঁচে থাকা বছরভর।


প্রথম ছবি – আলেয়ার বাঁধ পাহাড়ের উপর থেকে। ফটোগ্রাফার – লেখক। 
দ্বিতীয় ছবি – নীলগিরিতর। ফটোগ্রাফার – দেবতনু দত্ত। 
তৃতীয় ছবি – সোলায়ুর বাঁধ। ফটোগ্রাফার – রশ্মি গুহ রায়।

সৈকত ভট্টাচার্য

চেন্নাইপ্রবাসী ইঞ্জিনিয়ার। প্রেসিডেন্সি কলেজ কলকাতা আর আই আই টি মাদ্রাজ থেকে পাশ করে আপাতত চাকুরিরত একটি মার্কিন ফিনান্সিয়াল কোম্পানিতে। লেখালিখি টুকটাক চলে। শখ শর্টফিল্ম বানানো, ফোটোগ্রাফি আর সময় পেলেই পাহাড় কিংবা জঙ্গলে ঘুরে আসা।

Read Next: ‘People who are creative don’t die’

Join the Discussion

Your email address will not be published. Required fields are marked *