A+ A-

ভাগলপুরী বঙ কানেকশান – ২

প্রতাপ কলকাতার ছেলে। খাস ভবানীপুরে ওদের বাড়ি। বিয়ে করেছে বছরখানেক হয়ে গেল। ওর স্ত্রী নিভা ভাগলপুরের মেয়ে। এখন শ্বশুরবাড়িতে স্বামীর সংসারের হেঁসেল ঠেলে ‘সাথ নিভাচ্ছে’। 

 

নিভার আগ্রা যাওয়া হল না আর আগ্রা ‘ঘুমতে’ গিয়ে তাজমহল দেখাও হল না। কী আর করা যাবে, কপালে বেড়ানো না থাকলে তো কিছু করার নেই। এদিকে প্রতাপও ক’দিন ধরেই ভাবছিল নিভার কথা। যতই ওর কথায় রাগ হোক, হাজার হোক তারই তো বউ। সেই বিয়ের পর যেদিন থেকে এই বাড়িতে এসেছে, বেচারি বাড়ি ঘর সামলানো ছাড়া কিছুই করেনি। সত্যিই তো, মেয়েটার রিক্রিয়েশন বলে কিছু নেই, রিল্যাক্সেশন বলেও কিছু নেই। সে নিজেও ভাবে যদি কোথাও নিভাকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া যায়। কিন্তু অফিসে যা চাপ, তাতে ছুটি নেওয়া প্রায় অসম্ভব।
হঠাৎ একদিন প্রতাপ খবর পেল যে, ওর মামাতো বোনের দেওর আর দেওরের পরিবার পুরী যাচ্ছে। হঠাৎ ওর মনে হল, নিভাকে ওদের সাথে পাঠিয়ে দিলে হয়। বউটা বেড়িয়ে আসুক। বোনের সাথে কথা বলে নিল। টিকিটেরও ব্যবস্থা হয়ে গেল। বাড়ি ফিরে নিভাকে জিজ্ঞেস করল, “পুরী দেখেছ?”
– হাঁ, দেখেছি, বাবার খুব ফেভ্রিট। হরেক রবিবার বাবা সকালের নাস্তাতে পুড়ি-সবজি খেতে ভালবাসে।
– দূর, এটা পুরী, যেখানে সমুদ্র আছে, জগন্নাথ মন্দির আছে। গিয়েছ কখনও?
– না, বইতে পিকচার দেখেছি।
– যাবে?
বেড়াতে যাবার কথা শুনেই আনন্দে লাফিয়ে উঠল নিভা। বলল সে যাবে। প্রতাপ তখন ওকে বলল, “মিনুকে মনে আছে? আমার মামাতো বোন। বিয়েতে দেখেছ, কিন্তু খেয়াল নেই বোধ হয় তোমার… ওর দেওর, দেওরের বউ, বউয়ের মা-বাবা, সবাই পুরী যাচ্ছে। তোমার টিকিটও করতে দিয়েছি।”
– তুমি যাবে না ?
– আমার এখন অফিসে চাপ। আমি যেতে পারব না।
– কিন্তু এদের তো চিনি না কাউকে, এদের সাথে…
– অসুবিধের কী আছে। চেনো না, চিনে নেবে। টিকিট করতে দিয়ে দিয়েছি, না বলবে না।
কী আর করবে, নিভাকে পুরী যেতেই হল। সাতদিন পুরী বেড়িয়ে আবার ভবানীপুরের বাড়িতে ফিরেও এল। পুরীতে অনেক কেনাকাটাও করেছে সে। শাশুড়ির জন্য কটকি শাড়ি, শ্বশুরের জন্য মোষের শিঙের তৈরি পিঠ চুলকাবার লাঠি আর পুরীর গামছা, প্রতাপের জন্য একটা কটকি শার্ট এবং পাড়া প্রতিবেশীদের জন্য ‘কাকাতুয়া’র গজা। সবাইকে সব বিলি করে প্রতাপের জিনিস ওকে দেবার জন্য অপেক্ষা করে থাকল।
সন্ধ্যাবেলা প্রতাপ ফিরে এলে এক গাল হেসে নিভা প্রতাপকে ওর জন্য কেনা শার্টটা দিল। কপাল ভালো যে, সেটা প্রতাপের গায়ে ভালো ফিট করেছিল। প্রতাপ জিজ্ঞেস করল, “তুমি নিজের জন্য কিছু কিনেছ?”
– কিনেছিলাম। কিন্তু…
– কিন্তু কী ?
– আরে… সেই ছিলকাতে যেদিন গেলাম…
– ছিলকা না, ওটা চিলকা।
– হ্যাঁ, ওই। ওখানে দেখলাম কিছু লোক মোতি বেচছে। সামনে সিপি থেকে ফাটিয়ে মোতি বার করছে আর বিক্রি করছে। খুব সস্তা রেটে বিক্রি করছিল। আমিও একটা গলার আর কানের সেট বানাব ভেবে হাজার টাকার মোতি কিনলাম। পরে শুনলাম সেগুলো সব নকলি। একেবারে উল্লু বনে গেলাম।
কথা শুনে প্রতাপ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। অনেকক্ষণ ওভাবে বসে থাকতে দেখে নিভা আবার বলল, “মানছি তো আমি উল্লু বনে গেলাম।”
“সে তো বুঝলাম,” প্রতাপ বলল, “উলু বনে যখন গেলেই, মুক্তোগুলো ওখানেই ছড়িয়ে দিয়ে আসতে!”
নিভা বুঝতে পারল না কথাটার মানে।

প্রতাপ নিভা সুতীর্থ দাস

প্রতাপ ক’দিনের জন্য অফিসের কাজে কলকাতার বাইরে গিয়েছিল। ফিরে এসে দেখে বাড়িতে এক নতুন অতিথির আবির্ভাব ঘটেছে। নিভা না জানি কোথা থেকে দুটো খরগোশের ছানা জোগাড় করেছে। বাড়িময় দুটোতে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। দেখেই প্রতাপ চমকে গেল। চোখ ছানাবড়া করে সে জিজ্ঞেস করল, “এগুলো কী? কোথায় পেলে? কে দিয়েছে?” এক নিশ্বাসে সে বলে ফেলল কথাগুলো। নিভা লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল, “এ দুটো আমি পালছি। কাজের পরে এদের সঙ্গে আমার ভালো টাইম বিতে যায়।”
– তোমার তো টাইম বিতে যাবে, আমার টাইম-এতে খাওয়া জুটবে তো?
নিভা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে প্রতাপের দিকে। ও আজ অব্দি বুঝতে পারল না প্রতাপ যা বলে সেটা সিরিয়াসলি বলে, নাকি ইয়ার্কি করে বলে। যাই হোক, প্রতাপ যখন আপত্তি করেনি, তাহলে সব ঠিকই আছে। মোটামুটি খরগোশ আর প্রতাপ ঘোষকে নিয়ে বেশ কাটছিল তার দিনগুলো। পাশের বাড়ির ছোট্ট মেয়ে রিঙ্কিটাও বেশ ওর ন্যাওটা হয়ে গিয়েছে। আসলে যেদিন থেকে খরগোশ এসেছে রিঙ্কির প্রায় সমস্তটা সময়ই প্রতাপদের বাড়িতে কাটে। এসেই বলে, “আন্টি এই খরগোশ দুটো আমাকে দিয়ে দাও না প্লিজ।”
একদিন প্রতাপ বিকেলে বাড়ি ফিরে দেখে হৈ হৈ কাণ্ড। নিভা এক হাতে ঝাঁটা আর এক হাতে মগে জল নিয়ে বসার ঘরের একটা অংশ ধুয়ে পরিষ্কার করছে। প্রতাপ যা অনুমান করেছে, ঠিক তাই। খরগোশগুলো ঘরময় নোংরা করেছে। স্বচ্ছ ভারত অভিযানের বার্তা খরগোশগুলোর কানে যায়নি বলেই হয়তো এই অবস্থা। প্রতাপ কিছু আর বলল না এই বিষয়ে। ও দেখল, নিভা নিজেও বেশ বেকায়দায় আছে এই খরগোশ নিয়ে।
সেদিন তো যেমন তেমন করে কেটে গেল দিনটা। কিন্তু পরের দিন আরও বড় চমক অপেক্ষা করছিল প্রতাপ ঘোষের জন্য। অফিস থেকে ফিরে এসে যেন মনে হল সামথিং ইজ মিসিং। হ্যাঁ… যা ভেবেছে তাই! খরগোশগুলোকে সে আর দেখতে পেল না। কী ব্যাপার? সে নিভাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার দুই জগাই-মাধাইকে দেখছি না।”
– না।
– না মানে ?
– না… ওই রিঙ্কিটার ওগুলো খুব ভালো লেগেছিল। তাই আজ সকালে রিঙ্কির জন্য, ওদের ঘরে খরগোশ দুটো ‘ভেজে’ দিলাম।
প্রতাপ হতাশ মুখে নিভার দিকে চেয়ে থেকে শুধু বলল, “দিলেই যখন তাহলে ভেজে দিলে কেন? একটু বেশ পেঁয়াজ রসুন দিয়ে কষা করে রেঁধে পাঠাতে, তাহলে বেশ জমে যেত।”
আজ প্রথম নিভা প্রতাপকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি মজাক মারলে?”

প্রতাপ নিভা সুতীর্থ দাস

সেদিন রবিবার ছিল । অন্যান্য দিনের চেয়ে এইদিন একটু দেরিতেই ঘুম থেকে ওঠে প্রতাপ। চোখ খুলে মোবাইলে দেখল প্রায় সাড়ে ন’টা বাজে। বিছানা ছেড়ে উঠে, ঘর থেকে বেরিয়ে দেখল বাবা ব্যালকনিতে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। নিভা আর মা নাকি খুব সকালে বেরিয়েছে। পাড়ার মন্দিরে কীসের যেন পুজো দিতে গিয়েছে। প্রতাপ আবার ঘরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে টিভি-র সুইচটা অন করল। সেই একগাদা বস্তাপচা খবর। গোহত্যা থেকে গৃহবধূর আত্মহত্যা, সারদা থেকে বিবেকোৎসব, বিপিএল কার্ড থেকে আইপিএল-এর টিকিট… সেই রোজের একই গপ্পো। মাসিকে এক কাপ চায়ের জন্য হাঁক পেড়ে ও একটা সিগারেট ধরাল।
দশটা নাগাদ কলিংবেলের শব্দে বুঝল নিভারা ফিরেছে। কপালে ধেবড়ে যাওয়া একটা সিঁদুরের টিপ পরে হাসিমুখে নিভা বেডরুমে ঢুকে দেখল প্রতাপ তখনও বিছানায়। ওকে দেখে নিভা বলল, “এ বাবা… এ কী আছে ? এখনও উঠোনি।” প্রতাপ ওর কথার উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় গিয়েছিলে?”
– ওই তো আতাবাগানের মাতার মন্দিরে। আজ অমাওস হচ্ছে কিনা, পুজো দিতে গিয়েছিলাম আমি আর মা।
– বেরিয়েছ তো শুনলাম সেই কোন ভোরে। এতক্ষণ লাগল?
– আরে বাপ রে তোমাকে কী বলি… লম্বি লাইন ছিল। আমাদের তো নম্বর এখনও আসেনি।
– নাম্বার আসেনি তো চলে এলে যে?
– না না, মহল্লার একটা ছেলে বলল পুজোটা ওকে দিতে। সে ভিতর দিয়ে চ্যানেল ফিট করে নিয়ে গেল।
– বাহ ! এখানেও সেটিং?
– কী করব… এই রোদে মা-র কষ্ট হচ্ছিল। যাই হোক, পুজোর থালি পূজারীজিকে দিয়ে বললাম মালাগুলো রেখে দিতে আর পরে ভিড় কমলে ঠাকুরকে ‘চড়িয়ে’ দিতে।
– কী করতে ? ঠাকুরকে চড়িয়ে দিতে?
– হ্যাঁ, ওই মহল্লার ছেলেটা বলল, কিচ্ছু চিন্তা না করতে। ফুল, প্রসাদ আর মালা চড়িয়ে দিয়ে ও সামগ্রী বাড়ি দিয়ে যাবে। চা খাবার ইচ্ছা করেছে, ও আসবে।
প্রতাপ সব শুনে বলল, “আপাতত আমার ওই স্কাউন্ড্রেল ছেলেটাকে চড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।”

ছবি – লেখক


[সুতীর্থ দাসের এই সিরিজটি তাঁর ফেসবুক টাইমলাইন থেকে অনুমতিক্রমে প্রকাশিত। আশা করা যায়, আরও কয়েকটি পর্বে প্রতাপ আর নিভার গপ্পো আমরা পাব।]

সুতীর্থ দাস

জন্ম হরিয়ানা রাজ্যের ফরিদাবাদে। জন্মসূত্রে 'প্রবাসী' হলেও 'দেশ' 'ভারতবর্ষ'; পুরোদস্তুর বাঙালি। পেশাগতভাবে মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত; কাজ হল সৃজনশীল বিজ্ঞাপন রচনা। বর্তমানে এক বেসরকারি এফ এম স্টেশনে ক্রিয়েটিভ হেডের দায়িত্বে কর্মরত।

Read Next: কিছু ছ্যাঁচড়ামো আর বোকা-বোকা প্রেম

  • এতোদিন জানতাম ‘ভাগলপুরী গাই ‘বিখ্যাত। তুমি তো এখন ‘ ভাহলপুরী নিভা ‘ কেও বিখ্যাত করে দিলে!!!

Join the Discussion

Your email address will not be published. Required fields are marked *