এ কথা অনেকেই স্বীকার করে নেবেন যে স্কুল-কলেজ জীবনের সেরা সময়। সেই অনেকের মধ্যে আমিও একজন। স্কুলজীবনে এমন সব ঘটনা ঘটেছে, যা আদৌ ঘটতে পারে বলে ভাবিনি, এমন এমন চরিত্র দেখেছি যারা কোনওদিন উপন্যাস, সিনেমায় ভেসে ওঠেনি, কিন্তু তাঁদের ক্যারিশ্মা দিয়ে বাজিমাত করে বেরিয়ে গেছে। এই ক্যারিশ্মা ভীষণ মধ্যবিত্ত, অনেক বোকামিতে ভরা, বড্ড বেশি হেরে যাওয়া, হাত তুললে বগলের কাছে টিশার্টের ফুটো বেরিয়ে পড়ার লজ্জা, জোরে দৌড়াতে গিয়ে জুতো ছিঁড়ে যাওয়ার দুর্ঘটনা, গোটা অঙ্ক ঠিক করেও সিলি মিস্টেকে একটা শূন্য পাবার ওভার-কোয়ালিফিকেশন! স্মৃতি অনেকটা শরীরের কোনও জায়গায় গজিয়ে ওঠা বিনা নোটিসের চুলকুনির মতন। আমারও কেন জানি না হঠাৎ কিছু ছ্যাঁচড়া ছেলেদের কথা মনে পড়ে। একটা ওজনহীন হাসি ঠোঁটের কোণে লাইটারের প্রতীক্ষায় থাকা লম্বা সিগারেটের মতন ঝুলতে থাকে। ঘটনাগুলো ইলেভেন-টুয়েলভে পড়ার সময়, কিমবা তারপর কলেজে পড়ার সময়ের।
পিকু আমাদের সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ত। হেবি বিচ্ছু ছেলে, কিন্তু অঙ্কে ভালো। ওর বাবা নিজেকে জিন ও জিনিয়াসের মাঝামাঝি এক সিপিএম বলে ভাবতেন। একদিন আমি আর রাহুল পিকুর বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছি। রাস্তা অন্ধকার, আমাদের ভূতের মতন লাগছে। পিকুর বাবার ঘরটা ছিল রাস্তার ধারে। ঘরে দেখি আলো জ্বলছে। পিকু ওর বাবার টাক মাথায় দুটো হাত দিয়ে তবলা বাজাচ্ছে, তিনতাল। রাহুল বলল, “বুঝলি, নবরত্ন তেল মনে হয়।” আমি জানলার কাছে গিয়ে ডাকতেই পিকু চমকে উঠল, বাবার চোখ বন্ধ। “এখন ব্যস্ত আছি” — পিকু সেদিন দেখা করেনি। বাবার মাথায় পোকা নড়ে উঠলেই পিকুকে, বাবার টাকে তবলার নহবত বসাতে হত। আমি আর রাহুল হাসতে হাসতে রাস্তায় শুয়ে পড়েছিলাম। পিকু প্রতিশোধ নিতেও ছাড়েনি। ওর এই মালিশের সিক্রেট আমরা রাষ্ট্র করে দিয়েছিলাম। আমরা তখন অঙ্ক টিউশন সেরে সোজা কেমিস্ট্রি পড়তে যেতাম। সাইকেলে খানিকটা রাস্তা। মাঝখানে একটা হিসি করার বিরতি নিতাম। রাস্তার ধারে পরপর তিনজন দাঁড়াতাম। রাহুল একটু বেরসিক আর সিরিয়াসমার্কা ছেলে ছিল। আমি বলতাম, “চল কাটাকুটি খেলি”, কিমবা “কার নুনু বড় দেখি।” রাহুল ওসবে পাত্তা না দিয়ে দ্রুত হিসি শেষ করে কেটে পড়ত। পিকু ছিল জাত খচ্চর। সে নিজের নুনুটি হাতে নিয়ে সারা রাস্তা জুড়ে হোসপাইপের জল দেবার মতন হিসি করত আর মাঝে মাঝে আমাদের দিকে শান্তির জল ছেটাত। সেই শান্তির জল থেকে বাঁচতে আমাদের হাতে জল নিঃসরণকারী নুনু নিয়ে ডানদিক বাঁদিক সরতে হত। পিকু ছিল এক অতিমানব, ওর মূত্রাশয় ছিল একটা কুঁজোর আকারে, হিসি ফুরোতেই চাইত না। আমরা সাধারণ মানুষ, ফলে ওর দিকে হিসি উঁচিয়ে ধেয়ে যেতে পারিনি। একদিন রাস্তার মাঝ বরাবর হাতে নুনু নিয়ে ওরকম তাণ্ডব করছিল। অনেকটা পুরনো কলকাতার ভিস্তির মতন লাগছিল। ও বলত, “খুব গরম পড়েছে। রাস্তা তেতে আছে, একটু ঠান্ডা করে দিই।” সেদিন একটা লোক খুব জোরে সাইকেল চালিয়ে আসছিল। রাস্তার মাঝখানে একটি ছেলেকে হাতে নুনু নিয়ে জলক্রিয়া করতে দেখে জোরে ব্রেক মারে এবং পড়তে পড়তে বেঁচে যায়। আমাদের স্কুলের নাম জেনে হেড মাস্টারকে কমপ্লেন করবে বলে শাসান। পিকুর জন্য আমরাও কেস খেলাম, অথচ আমরা ভদ্র বাঙালির মতন রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে মুতছিলাম। পিকু তোতলা ছিল। লোকটা যাবার পর বলে, “ও বা-বা-বা-বাল ছিঁড়বে।” তারপর পিকু তিনদিন স্কুলে আসেনি। আমি আর রাহুলও খুব ভয়ে ভয়ে থাকতাম। এই বুঝি হেড স্যারের ডাক পড়ল!
আর এক ছোকরা ছিল আমাদের ক্লাসে, ওকে শিবু বলে ডাকা হত। রুমি নামে একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছিল। আহা, কী প্রেম, আজকাল এসব ভাবাই যায় না। তখন ‘সাথী’ নামে একটা বাংলা সিনেমা বেরিয়েছিল। শিবু ন’বার ‘সাথী’ দেখেছিল হলে গিয়ে। সেই মেয়েটিকে দেখবে বলে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকত। গানের লড়াই খেলার সময় একটা গানই গাইত — ‘ও বন্ধু তুমি শুনতে কি পাও’। বলাই বাহুল্য, এই গানটা ‘সাথী’র গান। শিবু মাঝে মাঝে অদ্ভুত সব কাণ্ড করত। স্কুলে পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপের জন্য পাসপোর্ট ছবি আনতে বলা হয়েছে। শিবু একটা নেগেটিভ ছবি এনে অফিসে জমা দিয়েছিল। শিবু সবেতেই জমিয়ে দিত, শুধু রুমির ব্যাপারেই বেচারা কেমন ছড়িয়ে ফেলত। এভাবেই একদিন জোলোর সঙ্গে মারপিট লেগেই যায়। জোলো এক অদ্ভুত ছেলে। সবকিছুতেই অভিমান করে, সবকিছুতেই সিরিয়াস হয়ে যায়, তাই লোকে জোলো বলে খ্যাপায়। জোলোর সঙ্গে রুমি এক ব্যাচে পড়ত। একদিন শিবু দেখে জোলো আর রুমি একটা অন্ধকার গলিতে অনেকক্ষণ গল্প করছে। শিবু ভাবে জোলো রুমিকে তোলবার চেষ্টা করছে। পরদিন টিফিনের সময় আমাদের ক্লাসরুমের পেছনে শিবু জোলোকে ডেকে নিয়ে যায়, তারপর গলা টিপে ধরে, বিচিতে লাথি মারে। তখন বিপি ওখানে দাঁড়িয়ে পেচ্ছাপ করছিল। সে পেচ্ছাপ থামিয়ে এসে জোলোকে বাঁচায়। ততক্ষণে আমরাও এসে গেছি। আমরা আরও হারামি। বলছি, “থামলি কেন, চালিয়ে খেল।” জোলো হঠাৎ কাঁদতে শুরু করেছে। হেবি চাপ। শালা মরাকান্না জুড়েছে, মালটাকে থামানো যায় না। জোলো কাঁদতে কাঁদতে বলল, “রুমি আমাকে রাখি দেয়। তুই এত নোংরা শিবু, এরকম কী করে ভাবলি।” এক ঢ্যামনা বলল, “এসব বালের কথা। রাখি দেয়, নাকি হামি দেয় কেউ জানে না। তুই ক্যালা জোলোকে।” আসলে জোলো অনেকের ঝাঁট জ্বালাত। তারাও ভাবল এই তালে মালটা একটু ক্যালানি খাক। অদ্ভুত ছেলে জোলো। আমি একদিন একটা ইঁট মেরেছিলাম ওর পিঠে। তারপর দৌড়ে পালাই। ও আমার পেছনে এসে আমায় ধরে ফেলে। আমি ভাবলাম, আমাকেও দু’ঘা দেবে বোধ হয়। জোলো কাঁদতে শুরু করল, “আমায় তুই ইঁট মারলি! আমি কি কুকুর!’ এর চেয়ে দু’ঘা মারলে বেটার ছিল।
যে বিপির কথা বলছিলাম, যে পেচ্ছাপ থামিয়ে জোলোকে বাঁচিয়েছিল। বিপি স্কুলের বাথরুমে হিসি করত না। সরকারি ইস্কুলের বাথরুমে যে অপূর্ব প্রাণঘাতী গন্ধ হয়, তা সে সইতে পারত না। ফলে ক্লাসরুমের পেছনে একটা মৃত নর্দমায় সে হিসি করত। ওর নাম অয়ন, রিয়া নামে একটা মেয়ের সঙ্গে প্রেম ছিল। ও যেখানে বসত, পেছনের বেঞ্চের ছেলেরা বলত, “অয়ন রিয়ার সঙ্গে প্রেম করে বাবার পোঁদ উজ্জ্বল করেছে।” বিপি বলত, “বাঁড়া, আমার বাবার পোঁদ চিরকালই উজ্জ্বল।” বিপি মানে বাবার পোঁদ।
এসব ঘটনা স্কুলজীবনের শেষ লগ্নের। তখন হাতে গোনা কয়েকজনের প্রেম হয়েছিল। তারপর আমরা কলেজে ভর্তি হলাম। আমরা সকলে প্রতিজ্ঞা করলাম, প্রেম করতেই হবে। প্রেম ছাড়া জীবন কচুবন, যে কচুবনে কালো কুকুরেও হাগে না। আমাদের বেশিরভাগ বন্ধু ছিল অশিক্ষিত এবং সেই অশিক্ষাকে কুশিক্ষায় রূপান্তরিত করতে তারা পশ্চিমবঙ্গের প্রাইভেট ইনজিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হল। ভর্তি হবার পর তাদের পোঁদে পিঙ্ক ফ্লয়েডের ফুসকুড়ি, বগলে মেটালিকার জড়ুল, কানে বাংলা রকের খোল, পদকুন্তলে হার্ডরকের চাম। এরা সিক্স পকেট প্যান্ট পরত, কারণ ওই পকেটে মালের নিপ নিয়ে ঘোরা যায়। এরা জানত চার বছর কাটিয়ে দিলেই, টিসিএস নামক গরুর গোয়ালে এদের ঠিকানা জুটে যাবে, মোটা মাইনে পাবে, সেক্সি বউ পাবে, পাটায়াতে লাগাতে যাবে। পৃথিবীর সমস্ত স্মার্টনেস এইসব প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছেলেদের মধ্যে নিহিত ছিল। এদেরই এক অবতার ছিল আমাদের বন্ধু, নাম অভি। এত বাতেলা দিত, যে গ্যাস ছাড়া আর কোনও ডাকনাম ভাবাই যায় না তার। তখন মধ্যবিত্ত বাঙালি মেয়েরা ইঞ্জিনিয়ার ছেলে হলেই গলে যেত। কারণ আগেই ব্যাখ্যা করেছি। যাই হোক, গ্যাসের প্রাণের বন্ধু ছিল রিক। রিক ভারী ভালো একটি ছেলে। এটাই ওর জীবনে কাল। এই ভালো লোকেদের বড় জ্বালা। গ্যাস পামেলা নামে একটি মেয়ের প্রেমে পড়ে। মেয়েটা বিশেষ পাত্তা দেয়নি, যদিও ফোনে বকত। তখন মেয়েরা ওইরকম কয়েকটা ফোনপ্রেমিক পুষে রাখত, কখন কী কাজে লাগে বলা যায় না। মেয়েটা অনেকদিন ফোনে ভাটানোর পরও প্রেমের কোনও হিন্ট দেয়নি। মেয়েরা এই ফোনপ্রেমিকদের ঝুলিয়ে রাখার ঝুলন খেলায় ভীষণ মজা পায়। একটু রেগে গিয়ে গ্যাস মেয়েটাকে একদিন চ্যালেঞ্জ করে, “তোকে আমি তুলে দেখাব।” তারপরেও মেয়েটা ফোনে কথা বলত।
গ্যাস প্রচুর বাজে হিন্দি সিনেমা দেখত। ফলস্বরূপ একটি রদ্দি প্ল্যান ফাঁদে। বেচারা রিক জড়িয়ে যায়। ওই যে বলেছি ভালো ছেলে, না বলতে পারে না। রিকের সঙ্গেও পামেলা কথা বলত ফোনে। ভালো ছেলে হবার সুবিধা, মেয়েরা কথা বলবেই, শেয়ার করবেই। গ্যাসের প্ল্যান অনুসারে রিক, পামেলাকে বলে, “শোন, আমি লুকিয়ে অভির ডায়েরি পড়েছি। ওর ব্রেন টিউমার আছে। জানি না কতদিন বাঁচবে। ও তোকে খুব ভালোবাসে। তোকে ছাড়া বাঁচবে না, যদিও আর কদিনই বা বাঁচবে।” এসব শুনে পামেলা গলে যায়।
রিক মেধাবী ছাত্র। সে গ্যাসকে বলে, “যদি পামেলা উঠে যায়, তাহলে কী করবি? তোর তো ব্রেন টিউমারে মরার কথা!” গ্যাস বলে, “মেডিকেল সায়েন্সে মিরাকেল হয়। আমিও একটা মিরাকেলে বেঁচে যাব, তারপর পামেলা আমার।” রিক ভালো ছেলে বলে এবারেও চুপ থাকে। গ্যাসের প্ল্যান শুনে ওই কথাটা মনে পড়ে — ‘বাঙালি শুধু খচ্চর নয়, তদুপরি অসহায়।’ গ্যাসের ব্রেনের টিউমার গালে হলদে ব্রণর মতন একদিন ফেটে যায়। পামেলার সিমপ্যাথি সিম পালটে অ্যালোপ্যাথি হয়ে ভীষণ তেতো হয়ে যায়। গ্যাস পামেলাকে তুলতে পারেনি। পামেলা রিককে উদুম খিস্তি করেছিল সেই ডায়েরি সংক্রান্ত গুলগল্পে সূত্রধরের ভূমিকা পালন করায়। রিক ভালো ছেলে বলে সেবারেও কিছুই বলতে পারেনি।
লেখার শেষে একটা পাদ, মানে পাদটীকা। আমরা তখন বন্ধুর প্রেম হবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তাম। গ্যাসের প্রেম হবার জন্যও ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। একদিন বিকেলে গ্যাস বলল, “চল, সবাই মিলে পামেলার বাড়িতে যাই।” আমি, রিক, গ্যাস আরও তিনজন পামেলার বাড়িতে হাজির হলাম। পামেলা একটা পিঙ্ক নাইটি পরে বেরিয়ে এল। গ্যাস এমন ভাব করছে যেন, পামেলাকে তুলেই ফেলেছে। আমরা সবাই পামেলার ঘরে বসলাম। এদিকে কী কথা বলব জানি না। রিক বলল, “চল গানের লড়াই খেলি।” গানের লড়াই হল বোরোলিনের মতন, কাটা থেকে ক্যানসার সব জায়গায় কাজ দেয়। যখন কথা নেই, আড্ডা জমছে না, গানের লড়াই হোক। রিক এই টোটকা বহু জায়গায় প্রয়োগ করে উপকার পেয়েছে। আমাদের গলা আর গোলার মধ্যে তফাৎ নেই। রিক কাশত বেশি, গাইত কম। গ্যাস খুব গম্ভীর হয়ে, শুধু প্রেমের গান গাইছে। আর আমরা ক্যাওরা, লারে লাপ্পা! বেরিয়ে আসার সময় পামেলার মা এলেন, পেশায় উকিল। কেউ অস্ফুটে বলল, “গ্যাসের শাশুড়ি।” রিক প্রণাম করতেই বলে উঠলেন, “শোনো, গান গেয়ে জীবন কাটে না, লাইফে একটু সিরিয়াস হও।” পরিবেশটা থমথমে। আমাদের গানের লড়াই গ্যাসের শাশুড়ির কানের পর্দায় হুল ফুটিয়েছে। আমি আর প্রণাম করার রিস্ক নিইনি। কারণ আমার গলা সবচেয়ে ভারী। মোরাল অফ দ্য স্টোরি হল, গুরুজনদের কথা সবসময় ঠিক হয় না। রিক এখন আমেরিকার এক বিখ্যাত ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক। ও সবচেয়ে বেশি সিরিয়াস ছিল আমাদের মধ্যে।
Join the Discussion