A+ A-

ঈশ্বরের সন্তান

আমার জন্মের পর আমার পিতা তেমন কিছু অনুভব করেননি। ভারতীয় উপমহাদেশে তাঁর পুত্র সন্তান হওয়া সত্ত্বেও তিনি চুপচাপ আমাকে আর মাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন। আমার বারো বছর বয়সে আমি একথা জানতে পারি। আমি হওয়ার সময়ে তিনি যে মায়ের অযত্ন বা অবহেলা করেছেন, তা নয়। বরং যেহেতু ওঁরা তখন জামশেদপুরে একা থাকতেন, পিতাকেই কমবেশি সব করতে হয়েছিল হাতে হাতে। তবু আমায় প্রথমবার কোলে নিয়ে আমার পিতা বিশেষ কিছু অনুভব করেননি। একথা আমি জানতে পারি আমার পিতার হিসেব রাখার খাতার পুরনো পাতা ওলটাতে গিয়ে।
আমার সাড়ে তেরো বছর বয়সে আমি জানতে পেরেছিলাম, মানুষ কীভাবে জন্মায়।

স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে সেদিন মায়ের মুখের দিকে তাকাইনি। মা পড়তে বসতে বলে এক গ্লাস দুধ রেখে গেছিল টেবিলে। সন্ধে আটটা পাঁচে আমার পিতা বাড়ি ফিরতে আমি নব গণিত মুকুল থেকে মুখ তুলে পিতার মুখের দিকে তাকাই। ভাবার চেষ্টা করি পিতাকে উলঙ্গ হলে কেমন দেখায়। নিজের উপর ঘৃণা করে। বাথরুমে ঢুকে আয়নায় তাকাই। আমাকে দেখি।
সপাটে দুটো চড় কষাই নিজের গালে। ছিঃ! এইভাবে মানুষ জন্মায়!

 

আমার পিতা আমাকে চোদ্দো বছরের জন্মদিনে সাইকেল কিনে দিলেন। চিত্ররথ সিনেমাহলের সামনের মাঠে আমায় নিয়ে গেলেন সাইকেল শেখাবেন বলে। আমি সাইকেলে চড়ে বসতে তিনি পিছন থেকে আমায় সামনের দিকে ঠেলে দিলেন। মাঠের সবুজ ঘাসের উপর নরম নরম শিশির। তার উপর দিয়ে প্যাডেল করছি আমি। আমার পিছনে ক্যারিয়ারে হাত রেখে ছুটে চলেছেন পিতা।
“আরও জোরে! আরও জোরে!”
আমি পিছন থেকে তাঁর হাঁপাতে থাকা গলা শুনতে পাই।
সাথে সাথে গত শনিবারের অফ পিরিয়ডের কথা মনে পড়ে যায় আমার। ক্লাসরুমের দরজা বন্ধ করে বিশাল সরকার আর অলকেশ রায় আমাদের একটা বই থেকে পড়ে শুনিয়েছিল সবিতা ভাবী — শ্রুতি নাটক। সেখানেও অলকেশ এমনই হাঁপাতে হাঁপাতে “আরো জোরে! আরো জোরে!”…
পিতার কণ্ঠস্বরে আমি মাঠে ফিরে এলাম, অনেক দূর থেকে যেন তাঁর আওয়াজ আসছে। পিছনে তাকিয়ে দেখি, মাঠের শহিদ মিনারের প্রান্তে তিনি দাঁড়িয়ে, আর আমি সিনেমাহলের মুখে, সাইকেলে একদম একা! ম্যাজিক! আমার চুলের মধ্যে দিয়ে হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। আমি প্যাডেল করছি জোরে, আরও জোরে। তখন ভেবেছিলাম আরও এটা-ওটা ম্যাজিকের মতো এই ম্যাজিকটাও আমার ব্যক্তিগত। দু’মাস পর জানতে পেরেছিলাম এটা বাপ্পা, রাহুল, বিশাল আর পিন্টুর সাথেও হয়েছে। যাই হোক, আরও কিছুদূর গিয়ে বুঝলাম আমার সামনেই মাঠের পাঁচিল। মাঠ শেষ। আর মাঠ শেষ হয়ে এলে কী করতে হয় পিতা আমায় বলে দেননি।

 

মাস দেড়েক পায়ে প্লাস্টার বেঁধে যখন বাড়ি বসেছিলাম আমি, তখন সময় কাটাবার জন্য একটু লেখালেখি শুরু করি। ওই ছড়া বা কবিতা যাকে বলে। ২০১৫ সালে বসে ২০০২ সালের একটা ডায়রির ফার্স্ট জানুয়ারিতে আমার প্রথম কবিতাটা লিখি। সেটা অনেকটা এই রকম ছিল —

এই যে আমার লেখালেখি
নয় কারও দেখাদেখি।
আমার ভুলেতে আমি
বিছানায় শয্যাশায়ী।
ডঃ সেন বলেছেন আমায়
পা যেন না নাড়ায়।
আমার গেঞ্জির রং অরেঞ্জ

অরেঞ্জের সাথে কোন শব্দ মেলে, আমি ভাবতে থাকি দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ দেখি একটা টিকটিকি — একটা নয় দুটো, একটার উপরে একটা। লেজে লেজ জড়ানো। যেহেতু আমি জেনে গিয়েছিলাম মানুষ কীভাবে জন্মায়, তাই আমার বুঝতে অসুবিধা হয়নি টিকটিকিও সেভাবেই জন্মায়। টিকটিকিতে আমি আগে থেকেই ঘেন্না পেতাম।
অরেঞ্জের সাথে মেলে এমন কোনও শব্দ আমার মাথায় আসেনি বলে সেখানেই আমার প্রথম কবিতা বা ছড়াটা শেষ হয়েছিল।
এরপর দশই জানুয়ারির পাতায় আমি লিখেছিলাম ‘আমার জনমের সময় পিতা নির্বিকার ছিলেন’ শীর্ষক এক চতুর্দশপদী সনেট।
সন্তান কবিতা লিখলে মা টের পেয়ে যান, পিতা পান না।
অঙ্ক না করে কবিতা লিখতে লিখতে ধরা পড়ে যাওয়ায় মা ডায়রিটা টান মেরে পাশের জানালা দিয়ে ছুঁড়ে দিয়েছিল। আমি কাঁদতে কাঁদতে জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখেছিলাম ডায়রিটা টুপ করে নিলিদের পুকুরে ঝরে পড়ল। এর পরপরই ক’দিন স্বপ্নে দেখেছিলাম পুকুরের মাছগুলো আমার কবিতা পড়ে বড় হচ্ছে। যেহেতু মাছেরা চোখ খুলে ঘুমোয়, আমি দেখেছিলাম খোলাচোখে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে লেবিও রোহিটা, হিলসা ইলসা-রা আমার কবিতা পড়ছে।

 

প্লাস্টার কাটার পর কোচিং ক্লাসে যাওয়া শুরু করেছি, এমন একদিন ক্লাস থেকে বেরিয়ে দেখি রাস্তার ধারে বন্ধুরা জটলা বেঁধে দাঁড়ানো। আস্তে আস্তে ওদের কাছে গিয়ে দেখি জটলার মাঝখানে দুটো কুকুর, পায়ে পা আটকে আছে, কুকুর দুটোও আমাদের দেখছে। হঠাৎ কী মনে হল, একটা ঢিল তুলে নিয়ে মারলাম ওদের গায়ে। আমায় দেখে বাপ্পাও একটা ঢিল তুলে নিল। পিন্টুও। রাহুলও। অলকেশও। বিশাল এই কোচিং ক্লাসে পড়ত না।
কুকুর দুটো কেঁউ কেঁউ করতে করতে সরে যেতে থাকল। কিন্তু আলাদা হল না।
সেদিন রাতেই কীসের আওয়াজে যেন ঘুম ভেঙে গেল। যেহেতু বছর দুই আগে থেকে আমি আর ভূতে ভয় পাই না, তাই বিছানা ছেড়ে নেমে বসার ঘরে চলে এলাম। একটু পরে বুঝলাম আওয়াজটা আসছে মা আর পিতার ঘর থেকে। সাথে সাথে আমি বুঝতে পারলাম মা এবং পিতা, একে অপরের সামনে বহু পূর্ব থেকেই উলঙ্গ হয়েছেন। আমি ঘরে ফিরে এলাম। বিছানায় শোওয়ার আগে আমার বারমুডাটা খুলে বিছানার পাশে রেখে দিলাম।

 

৬ই আগস্ট ২০১৫, আমার জীবনে একটা ম্যাজিক হল, বেশ বড় ম্যাজিক। এক যুগপুরুষ এলেন আমার জীবনে — তাঁর নাম অ্যাডলফ হিটলার। কোচিং ক্লাসে ইতিহাস পড়ার ফাঁকে তুলতুলিদি প্রথম তাঁর নাম উচ্চারণ করলেন, বাকিদের মতো আড়চোখে তুলতুলিদির বুক দেখতে দেখতে হঠাৎ আমার কানে সেই নাম এসে পড়ল। অ্যাডলফ… অদ্ভুত সুন্দর নাম। বাড়ি ফিরে এসে এনসাইক্লোপিডিয়া থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ খুলতেই দেখতে পেলাম তাঁকে। ঋজু দেহ, শান্ত স্থির চাহনি, সটান দাঁড়িয়ে আছেন এক বৃহত্তর মঙ্গলকর্ম সাধন করার জন্য, এক সুন্দর পৃথিবী গড়ার ইচ্ছায়। ঈশ্বরের পৃথিবী, প্রভু যিশুর পৃথিবী, আর্যদের নিজেদের এক স্বপ্নস্বর্গ।
সারারাত বিছানায় শুয়ে ঘুম এল না, নিজেকে নাৎসি বাহিনীর সদস্য হিসেব কল্পনা করতে থাকলাম। মাথার উপর দুই হাত তুলে কল্পনার বন্দুকের ট্রিগারে চাপ দিলাম, একেক করে মরে যেতে থাকল অলকেশ, বিশাল, তুলতুলিদি, কুকুর দুটো, দুটো টিকটিকি। আর সবশেষে পিতা। কী অদ্ভুতভাবে চতুর্বেদের এই দেশে আমার সাথে অ্যাডলফ জুড়ে গেলেন। আমাদের স্বপ্ন এক হয়ে গেল। আমরা চোখ বুজতে দেখতে পেলাম একটা সুন্দর পৃথিবী, আর্যদের পৃথিবী, ঈশ্বরের সন্তানের পৃথিবী। সেই পৃথিবীর বাসিন্দারা ঈশ্বরের থেকে জন্মাবে, মানুষের বিশ্রী কুৎসিত দেহ থেকে না। সেই পৃথিবীতে কোনও মানুষ মানুষের মতো করে জন্মাবে না। মাথার পাশে বারমুডাটা খুলে রেখে দিই। চোখ বুজে স্বপ্ন দেখতে দেখতে আমি গতি বাড়াই। ঘামতে ঘামতে, দ্রুতলয়ে, কাঁপতে কাঁপতে আমি এগিয়ে যাই ঈশ্বরের পৃথিবীর দিকে — জোরে, আরও জোরে।

অলোকপর্ণা

দশটা-উনিশটার বেসরকারি তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী, বাইশটা-তিনটের লেখক। প্রথম বই ঝিঁঝিরা (সৃষ্টিসুখ প্রকাশন)।

Read Next: বুলন্দ দরওয়াজা

Join the Discussion

Your email address will not be published. Required fields are marked *